নাসির উদ্দিন নাহিদ তালুকদার:
মাদারীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নানা অনিয়ম এবং অব্যবস্থাপনায় ভেঙ্গে পড়েছে স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থা। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে সুসজ্জিত স্থাপনা, প্রয়োজনীয় আসবাবসহ চিকিৎসার জন্য সরঞ্জাম থাকলেও দায়িত্বরত চিকিৎসক ব্যস্ত থাকেন প্রাইভেট ক্লিনিকে। এতে করে প্রতিদিন প্রয়োজনীয় সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন শত শত মা ও শিশু। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, মাদারীপুর সদর উপজেলার কালিকাপুর গ্রামের দিনমজুর আলী হাসানের স্ত্রী সিমা বেগম (২৭) প্রসব যন্ত্রণা শুরু হলে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে নিয়ে আসেন তার স্বজনরা। হাসপাতালে আসার পর সিমার স্বাভাবিকভাবে (নরমাল ডেলিভারি) সন্তান প্রসব করেন। কিন্তু পরিদর্শিকারা ওই রোগীর কাছ থেকে টাকা দাবি করে বলেন ওই টাকা আমাদের ম্যাডামকে দিতে হয়, না দিলে আমাদেরকে বদলী করে দিবে|রোগীর স্বজনরা বলেন, নরমাল ডেলিভারির ক্ষেত্রে কেন টাকা দিতে হবে প্রশ্ন করলে ভিজিটরা তাদের ম্যাডামের সঙ্গে কথা বলতে বলেন।মেডিকেল অফিসার তাদের সাথে অশোভন আচরণ করেন ,এবং টাকা না দেওয়ায় প্রয়োজনীয় সেবা দিতে গড়িমসি শুরু করে , আর বলে আমি এখানে আপনাদের এমনি কাজ করতে বসি নাই। পরে বাধ্য হয়ে তারা টাকা দেয় | জানা যায়, চিকিৎসক এবং নারী পরিদর্শকের কেন্দ্রে থাকার নিয়ম থাকলেও নানা অজুহাতে বেশিরভাগ সময় তারা অনুপস্থিত থাকেন। ফলে দূর-দূরান্ত থেকে আসা গর্ভবতী মা ও শিশুরা পড়েন চরম দুর্ভোগে। এলাকার মধ্যে সরকারি-বেসরকারি ভালো চিকিৎসাসেবা কেন্দ্র না থাকায় এ এলাকার লাখো নারী-শিশুর চিকিৎসাসেবা পাওয়ার ভরসাস্থলে পরিণত হয় কেন্দ্রটি। কিন্তু বর্তমানে কেন্দ্রটি তাদের দুর্ভোগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। সংশ্লিষ্ঠ একাধিক সূত্রে জানা যায়, এ বছর এপ্রিল মাসের দিকে সাবিনা বিনতে আলমগীর নামে এক নারী চিকিৎসক মাদারীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র মেডিকেল অফিসার পদে যোগদান করেন। তিনিই এই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের প্রধান। কিন্তু তিনি ঠিকমতো কোন গর্ভবতী রোগী দেখে না। এবং সে ঠিকমত মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে আসেন না। অভিযোগ রয়েছে, তিনি সরকারি সেবা না দিয়ে শহরের একটি বেসরকারি ক্লিনিকে নিয়মিত রোগী দেখেন। এবং গর্ভবতী মহিলাদের সিজারের মাধ্যমে সন্তান প্রসব না করার পরামর্শ দিয়ে নরমাল ডেলিভারি করানোর কথা বলে তাদের কাছ থেকে বিপুল পরিমাণে অর্থ দাবি করেন। অথচ তার দিনরাত ২৪ ঘন্টা এই মা ও শিশু কেন্দ্রে থাকার বিধান রয়েছে। ইমপ্ল্যান্ট ডাক্তারের নিজের পরানোর কথা থাকলেও তিনি আয়া ও নার্সদের দিয়ে পরান। এছাড়াও ভুয়া ডেলিভারি রিপোর্ট করার অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্র যে বাজেট আসে তার অল্প কিছু অফিসের জন্য রেখে সব টাকা সে নিজে খরচ করেন। এদিকে পরিচালক প্রশাসন ভিজিটে আসলে যা টাকা খরচ হয় সেই টাকাও সে পরিদর্শিকাদের কাছে নেন। প্রতিটি ঔষধ কোম্পানির কাছ থেকে সে মোটা অংকের টাকা নেন। একটি ডেলিভারি না করিয়েও নিজের নামে প্রতি মাসে ডেলিভারির রিপোর্ট দেখান তিনি। এবং দায়িত্বরত পরিদর্শিকাদের কাছ থেকে প্রতিমাসে টাকা দাবী করেন। যারা টাকা দিতে অস্বীকার করেন তাদেরকে বদলি করে দেন বলেও অভিযোগ। পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকা শাহনাজ বলেন,সাবিনা বিনতে আলমগীর ম্যাডাম ঠিকমতো অফিসে আসেন না। রোগী দেখেন না। প্রাইভেট ক্লিনিকে নিয়মিত রোগী দেখেন। এদিকে মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গর্ভবতী মায়েদের ডেলিভারি করানো পরে ম্যাডাম তাদের কাছ থেকে টাকা নিতে বলেন। আমরা অনৈতিক টাকা না নিতে চাইলে তিনি আমাদেরকে উল্টো চাকরি হারানোর ভয় দেখান। প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা দিলে চাকরি, না দিলে বদলি। এদিকে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক কয়েকজন পরিবার কল্যাণ পরিদর্শিকারা জানান, তার এ সকল অপকর্মে আমরা বাধা দেয়ায় সে আমাদেরকে দিয়ে অতিরিক্ত ডিউটি করানসহ আমাদেরকে বিভিন্ন যায়গায় বদলির ভয় দেখান।
আরেকজন পরিদর্শিকা বলেন, সে নিজের বাড়িতেও আমাদের এই মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের আয়া দিয়ে কাজ করিয়ে নেন। তারা কাজ করতে না চাইলে তাদেরকে চাকরি ছেড়ে দেবার হুমকি দেন।
ছয় মাসের গর্ভবতী শাহিদা আক্তার নামের এক রোগী বলেন, আমি তিন দিন মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রে গিয়ে ডাক্তারকে পাইনি। ঘন্টার পর ঘন্টা বসে থেকে পরে প্রাইভেট ক্লিনিক থেকে ডাক্তার দেখিয়ে বাসায় গেছি। আমরা গরীব মানুষ! সরকার আমাদের জন্য সরকারি হাসপাতাল করেছে, সেখানে আমাদের জন্য ডাক্তার দিয়েছে। তারপরও আমরা ডাক্তারের সেবা থেকে বঞ্চিত। মহিষেরচর পাকা মসজিদ এলাকার পারুল বেগম নামের দুই মাসের গর্ভবতী এক রোগী বলেন,আমি ১৫ দিন আগে আমার পেটে ব্যথা নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়ে দুই ঘন্টা অপেক্ষা করেও ডাক্তার পাইনি।
এসব অভিযোগের ব্যাপারে মাদারীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের মেডিকেল অফিসার সাবিনা বিনতে আলমগীর বলেন, যেসব পরিদর্শিকাদের বদলি করা হয়েছে তারাই আমার নামে মিথ্যা অভিযোগ দিচ্ছে। টাকা চাওয়ার বিষয়য়ে জানতে চাইলে তিনি আরো বলেন, কয়েকদিন আগে একটি শিশু মারা গেছে। তখন প্রশাসন ম্যানেজ করতে কিছু খরচাপাতি দিতে হয়েছে। এ কারণে আমি তাদের কাছ থেকে টাকা নিয়েছি। তিনি আরো বলেন, আর আপনারা তো অবশ্যই জানেন কোন কিছুই হলেই সাংবাদিকরা ছুটে আসে তখন সাংবাদিক সহকারে প্রশাসকের লোকদেরকে আমাদের কিছু কিছু সম্মানী করতে হয়। কয়েকদিন আগে পরিচালক ভিজিটে এসেছে তাদের জন্য খরচ আছে। সেটা কি আমি আমার নিজের থেকে খরচ দিবো। তাই সবার থেকে তুলে নিয়ে দিয়ে দিছি। এটা যদি আমার কোন অপরাধ হয় তাহলে হোক সমস্যা নাই আমার। তাদের দোষ আমাদের উপর চাপাইছে। এদিকে ক্লিনিকে বসে রোগী দেখার বিষয়টি সত্যতা স্বীকার করেন তিনি । মাদারীপুর মা ও শিশু কল্যাণ কেন্দ্রের উপ-পরিচালক মো. অলিউর রহমান বলেন, এ বিষয় আমাদের কাছেও যদি কেউ অভিযোগ করে তাহলে আমরা তদন্ত সাপেক্ষে তার বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহন করবো।
আলোকিত প্রতিদিন /২১ সেপ্টেম্বর ২৩/মওম
- Advertisement -