::নিজস্ব প্রতিবেদক::
আগামী ১০ মে দোকানপাট খুলে দেওয়ার মধ্যদিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়ে এসে করোনাভাইরাসের সামাজিক সংক্রমণের পথ সরকার আরও সুগম করে দিয়েছে, বলে অভিযোগ করেছে বিএনপি। দলটি মনে করে, জনগণের কাছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকারের জবাবদিহিতা না থাকার কারণেই লকডাউন তুলে নিয়ে দেশকে ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আর এই সিদ্ধান্তের পরিণতির জন্য বর্তমান সরকারকে এককভাবেই দায়ী থাকতে হবে বলে জানিয়েছেন বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
আজ মঙ্গলবার (৫ মে) রাজধানীর গুলশানে চেয়ারপারসনের কার্যালয়ে অনুষ্ঠিত সংবাদ সম্মেলনে দলের এসব অবস্থান তুলে ধরেন বিএনপির মহাসচিব। রবিবার (৩ মে) রাতে স্থায়ী কমিটির অনলাইন বৈঠকে আলোচনার পর দলের বিভিন্ন পর্যালোচনার কথা তুলে ধরেন মির্জা ফখরুল। সোমবার (৪ মে) জনগণের চলাচলে নিষেধাজ্ঞা শিথিল করে রমজান ও ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে সীমিত পরিসরে দোকানপাট ও শপিং মল আগামী ১০ মে থেকে চালু রাখার নির্দেশনা দেয় মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে একইদিন সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রশাসনের উদ্দেশে বলেন, ‘ঈদের সময় মানুষ কেনাকাটা একটু করবেই। বাজার একটু করতেই হবে। এটা বন্ধ করা ঠিক হবে না। মানুষকে সচেতন করে এই ব্যবস্থাটা করতে হবে।’
বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল সরকারের এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করেন। তিনি বলেন, ‘আইইডিসিআরের বরাতে প্রকাশিত সংবাদে দেখা যায়, মে মাসের তৃতীয় এবং চতুর্থ সপ্তাহ হবে বাংলাদেশের জন্য করোনার পিক সময়। ছুটির মেয়াদ আরও ১০ দিন বাড়ানো হলেও স্বাস্থ্যমন্ত্রী অঘোষিত লকডাউন আরও শিথিল করার যে ইঙ্গিত দিলেন, তা রীতিমতো অ্যালার্মিং। আগেই বলেছি, বাংলাদেশ সরকার এটাকে সাধারণ ছুটি আখ্যায়িত করেছে, লকডাউন নয়। ফলে মানুষও এর গুরুত্ব সেভাবে অনুভব করেনি।’
ফখরুল জানান, বিএনপি মনে করে করোনাভাইরাসের এই মহাদুর্যোগ জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সম্মিলিতভাবে মোকাবিলা করা সময়ের দাবি। আরও কিছু দিন সামাজিক দূরত্বের নীতি কঠোরভাবে মানা উচিত ছিল বলে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘সরকার রমজান ও ঈদের কথা বলে প্রথমে তাৎক্ষণিকভাবে, পরবর্তীতে সিদ্ধান্ত বদলে ১০ মে থেকে দোকানপাট খুলে দিয়েছে দূরত্ব ও অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালন সাপেক্ষে। এতে করোনার পিক পয়েন্টে এসে সরকার পুনরায় সামাজিক সংক্রমণের পথ আরও সুগম করে দিলো।’
গার্মেন্টস সেক্টরে সৃষ্ট ঝুঁকির সঙ্গে দোকানপাট খুলে দেওয়ার ফলে সম্ভাব্য ঝুঁকি অগ্নিতে ঘৃতাহুতির মতো কাজ করবে বলে দাবি করেন বিএনপির মহাসচিব। তিনি বলেন, ‘সুইডেন মডেল অনুসরণ করে এ কাজ করা হয়েছে বলে যুক্তি দেখানো হলেও সুইডেনের জনগণের সামাজিক সচেতনতা ও স্বপ্রণোদিত দায়িত্ববোধ রয়েছে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে তুলনীয় নয়। তাছাড়া সুইডেনেও তাদের স্বাস্থ্য বিভাগ উন্মুক্ত চলাফেরার বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে রয়েছে। লক্ষণীয় যে, এই সিদ্ধাস্তটি নিতেও সরকারের দোদুল্যমনতা পরিলক্ষিত হয়েছে, যা এহেন জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ সময়ে কাম্য নয়।’
করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার চরমভাবে ব্যর্থ বলে উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘১৬ মার্চ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে কেক কাটাসহ নানা কর্মসূচি পালন করে সরকার দলীয় অঙ্গসংগঠনগুলো। এতে শত শত মানুষ সমবেত হয়। পরবর্তীতে বিভিন্ন জানাজায় সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার পরামর্শ উপেক্ষিত হয়। সরকারের অপরিপক্কতা, অদক্ষতা, অদূরদর্শিতা ও সীমাহীন অযোগ্যতার আর কি কোনও বড় প্রমাণের প্রয়োজন আছে। পরিহাসের বিষয় হলো, সরকারের এই ব্যর্থতা জাতি হিসেবে আমাদের সবাইকে এক চরম বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিলো।’
স্বাস্থ্যখাত সম্পূর্ণভাবে ভেঙে পড়েছে দাবি করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘করোনা টেস্ট কিটসহ সরবরাহকৃত মালামালের গুণগত মান নিয়ে অভিযোগ করায় কমপক্ষে ২টি হাসপাতালের পরিচালক দু’জন চিকিৎসককে বদলি করা হয়েছে। যদিও পরবর্তীতে সরকারি অনুসন্ধানেই সরবরাহকৃত মাস্ক, পিপিই ত্রুটিপূর্ণ বলে আখ্যায়িত হয়েছে এবং সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান ক্ষমা চেয়েছে। তাহলে চিকিৎসকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হলো কেন?’ তিনি আরও বলেন, ‘করোনা চিকিৎসার সঙ্গে সরাসরি সম্পৃক্ত ৪১৯ জন ডাক্তার, ২৪৩ জন নার্স, ৩২৪ জন অন্যান্য স্বাস্থ্য সেবাকর্মীসহ সর্বমোট ৯৮৬ জনের নমুনা পরীক্ষায় পজিটিভ শনাক্ত হয়েছেন। দুই জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক মৃত্যুবরণ করেছেন। অপরদিকে পুলিশে আক্রান্তের সংখ্যা বেড়েই চলেছে। ৩ মে’র তথ্য অনুযায়ী, দেশজুড়ে ৮৫৪ জন পুলিশ সদস্যের দেহে করোনা শনাক্ত হয়েছে। পাঁচ জন পুলিশ সদস্য মারা গেছেন।’
মানুষের জীবন ও জীবিকা দুটোই ঠিক রাখতে হবে বলে উল্লেখ করে বিএনপির মহাসচিব বলেন, ‘সংক্রমণ যেহেতু এখনও ঊর্ধ্বমুখী সেহেতু আরও কিছুদিন অবরুদ্ধ ও সামাজিক দূরত্ব বজায়ের নীতিমালা কঠোরভাবে পালন করা উচত ছিল। এরপর সংক্রমণ পরিস্থিতি সহনীয় পর্যায়ে এলে, তখন কারখানাগুলো খুলে দেওয়া ভালো হতো বলে অনেকে মনে করেন। কেননা, জীবন ও জীবিকার মধ্যে নিঃসন্দেহে জীবন প্রাধান্য পাবে। কেবলমাত্র আর্থিক দিক বিবেচনা করে জীবনের গুরুত্ব গৌণ করা সঠিক নয়।’
গার্মেন্টস শ্রমিকদের বেতন পরিশোধের জন্য ৫ হাজার কোটি টাকার ঋণ প্যাকেজ ঘোষণা করা হলেও অধিকাংশ শ্রমিক এখনও তাদের বেতন পাননি বলে দাবি করেন বিএনপির মহাসচিব। সুষ্ঠুভাবে করোনা সংকট মোকাবিলার জন্য সম্পদশালী রাষ্ট্র হওয়াটা জরুরি নয় উল্লেখ করে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বৈশ্বিক অভিজ্ঞতার দেখা যায় যে, যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের তুলনায় ভিয়েতনাম, নেপাল-ভুটান এমনকি ভারতের কেরালা রাজ্যে তাদের আন্তরিকতা, দক্ষ ব্যবস্থাপনা এবং দরিদ্র মানুষের জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে সরাসরি আর্থিক-গ্রান্ট তুলে দেওয়ার মাধ্যমে এ সাফল্য অর্জন করেছে।’
বর্তমানে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতি বিরাজ করছে বলে জানিয়ে মির্জা ফখরুল বলেন, ‘বাংলাদেশেও আমরা এবং অন্যসব রাজনৈতিক দল জাতীয় এই সন্ধিক্ষণে ১৯৭১ সালের ন্যায় সম্মিলিতভাবে জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে এ মহাদুর্যোগ মোকাবিলার আহ্বান জানিয়েছিলাম। কিন্তু দুঃখের বিষয় এহেন বিভীষিকাময় পরিস্থিতিতেও ঐক্যের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে সরকার একদলীয় ভিত্তিতে কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতে গিয়ে সবকিছু লেজেগোবরে একাকার করে ফেলেছে। এই পরিস্থিতির দায় এককভাবে বর্তমান সরকারকেই বহন করতে হবে।’