আজ মঙ্গলবার, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।   ১৮ নভেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

যশোরের কেশবপুরে হুনুমানের সংখ্যা বাড়ছে

-Advertisement-

আরো খবর

রুহুল আমিন:
যশোরের কেশবপুরের ঐতিহ্যবাহী কালোমুখ হনুমানের সংখ্যা বাড়ছে। কিন্তু ‘নিজেদের মধ্যে দলাদলি’, নিরাপদ আশ্রয়ের অভাব, খাদ্য সংকটের কারণে ইতোমধ্যে অনেক হনুমান স্থান ত্যাগ করেছে। তারা আশপাশের জেলা-উপজেলাতে ছড়িয়ে পড়েছে। স্থানীয় বাসিন্দা, বন বিভাগের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে এ তথ্য জানা গেছে।
কেশবপুরে ২০১৬ সালের দিকে বিলুপ্তপ্রায় এ প্রাণীটির সংখ্যা ছিল প্রায় তিনশ। ইতোমধ্যে সেই সংখ্যা বেড়ে চার শতাধিক হয়েছে বলে জানান কেশবপুর উপজেলা বন কর্মকর্তা সমীরণ বিশ্বাস। তার দাবি, উপজেলা পরিষদ চত্বরেই দেখা মিলবে বাচ্চাসহ শতাধিক কালোমুখ বানর। এছাড়া পাশেই উপজেলা হাসপাতাল চত্বর, বালিয়াডাঙ্গা মন্দির ও হরিহর নদীর ধারের মহাশ্মশান এলাকা, খতিয়াখালী ও পুলেরহাট বাজার এলাকায় একটু বেশি চলাচল।
কালোমুখ হনুমানের বৈজ্ঞানিক নাম Semnopithecus entellus। বাংলাদেশ বন অধিদপ্তরের বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণ দপ্তর সূত্রে জানা যায়, এই প্রজাতির হনুমান প্রায় ২০০ বছর ধরে যশোরের কেশবপুর ও মণিরামপুর অঞ্চলে বসবাস করে আসছে। এদের গড় আয়ু ১৮-৩০ বছর। সাধারণত জুলাই-অক্টোবর বা কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেব্রুয়ারি থেকে এপ্রিল এদের প্রজননকাল। স্ত্রী হনুমান ২০০ থেকে ২১২ দিন গর্ভধারণের পর সাধারণত ১-২টি বাচ্চা প্রসব করে। বন্যপ্রাণী (সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা আইন)-২০১২ অনুযায়ী হনুমানের এ প্রজাতিটি সংরক্ষিত। কেশবপুর পৌরএলাকার বাসিন্দা রেজাউল করিম বলেন, কালোমুখ হনুমান আমাদের ঐতিহ্য। কিন্তু তাদের থাকার নিরাপদ জায়গা, প্রয়োজনের তুলনায় কম খাবারের কারণে এখন এই হনমুানগুলো স্থান ছেড়ে যাচ্ছে। তারপরও কেশবপুর পৌরশহরে বিশেষ করে উপজেলা চত্বর, হাসপাতাল চত্বরে তাদের সরব উপস্থিতি লক্ষ্য করা যায়। সরকারের উচিৎ বিলুপ্তপ্রায় এ প্রজাতির প্রাণীটি সংরক্ষণে আরও বেশি কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ।
বালিয়াডাঙ্গা মোড়ের ব্যবসায়ী মোহাম্মদ সেলিম বলেন, হনুমানের জন্য প্রয়োজনীয় খাদ্য সরবরাহ হয় না। প্রায়ই তারা এই বাজারের ব্যবসায়ীদের দোকান থেকে খাবার নিয়ে পালায়। আমার দোকান থেকেও দুদিন আগে পটেটো চিপসের ২০-২৫টি প্যাকেট নিয়ে চলে যায়।
একই কথা বললেন সুজাপুরের কৃষক আব্দুল হালিম। তিনি বলেন, মাঝেমধ্যে পাড়ার লোকজনের ঘরে প্রবেশ করে হনুমানগুলো তাণ্ডব চালায়। তারা আমার ঘরের টালি ভেঙেছে, ঘরের ভেতর ঢুকে জিনিসপত্র তছনছ করেছে। খুব অত্যাচার করে।
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, বছর দশেক আগে একটি বেসরকারি সংস্থা কেশবপুরের হনুমানদের জন্য প্রয়োজনীয় ফলদ ও বনজ বৃক্ষরোপণের কাজ শুরু করে। কিন্তু দুই-তিন বছরের মধ্যে অতিবৃষ্টি এবং জলাবদ্ধতায় অনেক গাছ নষ্ট হয়ে যায়। কালোমুখ হনুমান এখানকার জনজীবনের সঙ্গেই মিশে আছে। কিন্তু খাদ্যের অভাব, থাকার জায়গার সমস্যা, বৈদ্যুতিক ক্যাবলে জড়িয়ে অপমৃত্যু এবং কিছু দুষ্ট লোকের নির্যাতনে হনুমানের অপমৃত্যু হচ্ছে। আবার খাদ্যের সন্ধানে অনেক হনুমান এলাকা ছেড়েও চলে যায়।
কথিত আছে, ব্রিটিশ আমলে দক্ষিণ ভারতের কয়েকজন মাড়োয়ারি ব্যবসায়ী ব্যবসার উদ্দেশ্যে কেশবপুরে আসেন। তারা কয়েকটি কালোমুখ হনুমান সঙ্গে এনেছিলেন। সেগুলোই বংশবৃদ্ধি করে এ অঞ্চলে নিজেদের ‘হনুমান সাম্রাজ্য’ সৃষ্টি করেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে এখানে দুই হাজারের মতো কালোমুখ হনুমান ছিল বলে জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তবে বন উজাড়করণ, গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া, খাদ্যাভাব এবং মানুষের অত্যাচারে তাদের সংখ্যা কমতে থাকে।
 সরেজমিন দেখা যায়, খাদ্য প্রদানের দায়িত্বে থাকা ঠিকাদারের কর্মচারী আতিয়ার রহমান নতুনহাট এলাকায় হনুমানগুলোর জন্য এনেছেন পাকাকলা, বাদাম, বনরুটি আর আলু। সেগুলো নিয়ে হনুমানদের একাংশ চলে গেলেও কয়েকটি খাচ্ছিল। তিনি জানান, পাঁচটি স্পটে সকাল ও বিকালে দুই দফায় খাবার দেওয়া হয়। খাবারের মধ্যে প্রতিদিনের জন্যে ৪৭ কেজি পাকা কলা, বনরুটি ৬ কেজি ৭০০ গ্রাম, বাদাম ৭ কেজি ৩০০ গ্রাম, আলু ৬ কেজি ৮০০ গ্রাম। সবজি প্রতিদিন একইরকম হয় না। হনুমানগুলো একই সবজি বারবার খায়ও না। সেক্ষেত্রে আলু, বেগুন, পটোল, ঢ্যাঁড়স বদল করে দিতে হয়। প্রায় ১৮ বছর ধরে তিনি হনুমানগুলোর খাবার দিয়ে আসছেন বলে জানান।
খাবার সরবরাহকারী তুহিন এন্টারপ্রাইজের মালিক ইয়াসির আরাফাত সান বলেন, গত দুই বছর টেন্ডারের মাধ্যমে আমি খাবার সরবরাহ করে আসছি। প্রতিদিন সকালে উপজেলা পরিষদ চত্বর থেকে খাবার অফিসের স্টাফের সামনে মেপে আনা হয়। সেকারণে ওজনে কারচুপির কোনো সুযোগ নেই। টেন্ডার অনুযায়ীই খাবার সরবরাহ করে আসছি।
সামাজিক বন বিভাগ যশোরের রেঞ্জ অফিসার এমএম মিজানুর রহমান বলেন, কেশবপুরে চার শতাধিক হনুমান রয়েছে। এগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি পেলেও সবাই থাকে না। কেননা হনুমানগুলো এক জায়গায় স্থির নয়। আর একেকটি দলে দুটির বেশি পুরুষ হনুমানও থাকে না। সংখ্যায় বেশি হলে নিজেরাই মারামারি করে আরেকটি গ্রুপ করে অন্যত্র চলে যায়। তাই অভয়ারণ্য তৈরি করে এদের এক জায়গায় আটকে রাখা কঠিন।
সরকারি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে হনুমানগুলো রক্ষণাবেক্ষণের চেষ্টা করা হচ্ছে জানিয়ে তিনি বলেন, সামাজিক বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে যশোরের কেশবপুর ও ঝিনাইদহের মহেশপুরে হনুমানদের খাবারের জন্য টেন্ডার করা হয়। সামনের মাসেই টেন্ডার আহ্বান করার কথা রয়েছে। তাদের খাবারের জন্য ২০ লক্ষাধিক টাকা বরাদ্দ থাকে। সেক্ষেত্রে কেশবপুরে ১৩-১৪ লাখ টাকার মতো বরাদ্দ হতে পারে।
আলোকিত প্রতিদিন/০২নভেম্বর ২০২৫/মওম
- Advertisement -
- Advertisement -