আজ সোমবার, ১৪ আশ্বিন ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।   ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

ভারতীয় বাধার মুখে রপ্তানি বাণিজ্য. খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ. সংকটে বাংলাদেশ

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

আলমগীর মতিন চৌধুরীঃ বাংলাদেশ ভারত সম্পর্ক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। ভারতীয় বাধার মুখে ব্যবসা বাণিজ্য। খরচ বেড়েছে ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিবর্তন পরবর্তী একতরফা নিষেধাজ্ঞায় সংকটে পড়েছে বাংলাদেশ, তৈরি করেছে বাণিজ্য চ্যালেঞ্জ। ভারত সম্পর্কের টানাপোড়নে থমকে গেছে আমদানি রপ্তানী। ভারত বাংলাদেশের স্থলপথে রপ্তানির ওপর সম্প্রতি নিষেধাজ্ঞা দফায় দফায় বিধিনিষেধ আরোপ করেছে। স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পাটজাত দ্রব্য, পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, প্লাস্টিক, কাঠের আসবাব, সুতা ও সুতার উপজাত, ফল, কোমল পানীয়সহ কয়েকটি পণ্যের আমদানিতে বিধিনিষেধ আরোপ করার কারণে দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্যের খরচ প্রায় ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। অশুল্ক বাধার মুখে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আসা যাওয়া কমে যাওয়ায় ব্যবসায়ীরা এখন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে শিল্পের কাঁচামাল আমদানি ও রপ্তানি করতে বাধ্য হচ্ছেন, যা সময় সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, আলোচনার জন্য নয়াদিল্লিকে অনুরোধ করা হলেও আসেনি কোনো জবাব। ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের বাণিজ্যের পরিমাণ বছরে ১৫ বিলিয়ন ডলারের বেশি। চীনের পর ভারতই বাংলাদেশের জন্য পণ্য ও কাঁচামালের দ্বিতীয় বৃহত্তম উৎস। চলতি বছরের এপ্রিলের শুরুতে ভারত তৃতীয় দেশে বাংলাদেশি রপ্তানি পণ্যের জন্য ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা স্থগিত করলে বাণিজ্য সংকটের সূচনা হয়। এর এক সপ্তাহ পরেই ঢাকা ১১টি স্থলবন্দর দিয়ে ভারত থেকে সুতা আমদানি স্থগিত করে দেয়। এরপর মে মাসে বাংলাদেশের তৈরি পোশাক, প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, আসবাবসহ বেশ কিছু পণ্যের ওপর বিধিনিষেধ আরোপ করে নয়াদিল্লি। ভারতের ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) বলেছে, ভারতে বাংলাদেশের একক বৃহত্তম রপ্তানি পণ্য তৈরি পোশাক শুধুমাত্র কলকাতা বন্দর এবং মুম্বাইয়ের নবসেবা বন্দর দিয়ে প্রবেশ করতে পারবে। স্থলপথে বাণিজ্য বাধাগ্রস্ত হলেও সমুদ্রপথ এখনো খোলা রয়েছে। তবে এতে খরচ ও সময় দুটোই বেশি লাগছে। এসব পদক্ষেপের মাধ্যমে সরাসরি শুল্ক বাড়ানো না হলেও কার্যত আমদানি-রপ্তানির বাস্তব পথ সংকুচিত করা হয়েছে। বৈদেশিক বাণিজ্যে এসব পদক্ষেপকে অশুল্ক বাধা হিসেবে বিবেচনা করা হয়। ভারতের সঙ্গে বাণিজ্য টানাপোড়েন কমাতে চায় বাংলাদেশ। বরাবরই ভারতে রপ্তানি দ্রব্যের সিংহভাগই যেত স্থলবন্দর দিয়ে। এখন চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাতে হওয়ায় পরিবহন খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়েছে। ভারতীয় আমদানিকারকেরা প্রায়ই পণ্য পৌঁছাতে দেরি হওয়া এবং পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়া নিয়ে অভিযোগ করছেন। এ কারণে ভারতীয় আমদানিকারক নয়াদিল্লিতে বাংলাদেশি হাইকমিশনারের সঙ্গে দেখা করে আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের অনুরোধ জানিয়েছেন। তবে এখনো কোনো বৈঠক হয়নি। খরচ বাড়ায় ভারতে রপ্তানিতে ভাটা পড়তে শুরু করেছে। বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, অশুল্ক বাধা নিয়ে আলোচনার জন্য তিনি ভারতে সচিব পর্যায়ে তিনবার চিঠি দিয়েছেন, কিন্তু কোনো উত্তর পাননি। বাণিজ্য উপদেষ্টা নিজেও ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রীকে আলোচনার জন্য চিঠি লিখেছেন বলে তিনি আলোকিত বাংলাদেশকে জানান। বাণিজ্য সচিব বলেন, ভারতীয় পক্ষ কেন বৈঠকে আগ্রহী নয়, সে বিষয়েও কিছু বলছে না। অশুল্ক বাধার কারণে ব্যবসার খরচ ২০ শতাংশ পর্যন্ত বেড়ে গেছে। সাধারণত প্রতিবছর সচিব পর্যায়ে বৈঠক হলেও গত দেড় বছরে দুই দেশের মধ্যে এমন কোনো বৈঠক হয়নি বলেও জানান বাণিজ্য সচিব। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক পোশাক রপ্তানিকারক জানান, স্থলবন্দরে বাণিজ্য বন্ধ থাকায় তার ভারতীয় অংশীদার ২০ লাখ ডলারের পোশাক আমদানি বন্ধ করে দিয়েছে। প্রতিষ্ঠানটি এখন থাইল্যান্ড ও মালয়েশিয়ার বাজারের জন্য ভারতীয় সরবরাহকারীদের কাছ থেকে পণ্য সংগ্রহ করছে। ইন্ডিয়া-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (আইবিসিসিআই) যুগ্ম মহাসচিব আবদুল ওয়াহেদ বলেন, এপ্রিল থেকে পাল্টাপাল্টি পদক্ষেপ শুরুর পর কিছু স্থলবন্দরে ভারত থেকে পণ্য আমদানি ৫০ শতাংশের বেশি কমে গেছে। আগে কিছু বন্দর দিয়ে দিনে ৪০০ ট্রাক এলেও এখন তা ১৫০টি ট্রাকে নেমে এসেছে বলে জানান এই ব্যবসায়ী সংগঠনের কর্মকর্তা। তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্য সম্পর্ক এখন স্বাভাবিক নেই। দুই দেশের সরকারেরই এই অশুল্ক বাধাগুলো দূর করা উচিত। অনেক ক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে যেখানে আগে ১ টাকা খরচ হতো, এখন সেখানে ১০ টাকা খরচ হচ্ছে। জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) তথ্য অনুযায়ী, স্থলবন্দরগুলোতে বাণিজ্য কমলেও চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বেড়েছে। চলতি বছরের প্রথম আট মাসে (জানুয়ারি-আগস্ট) চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ভারতে রপ্তানি আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ১৩৯ শতাংশ বেড়ে ৩৩৮.২ মিলিয়ন ডলারে দাঁড়িয়েছে। অন্যদিকে মোংলা ও পানগাঁওসহ ১১টি স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য চলাচল কমেছে অর্থমূল্যে ১৫ শতাংশ ও পরিমাণে ১৯ শতাংশ। বিগত ইতিহাস ঘাটলে দেখাযায়, বাংলাদেশ ও ভারত বাণিজ্যিক সম্পর্ক সব সময় মসৃণ ছিল না। কিন্তু সাম্প্রতিক সময়ে এর অবনতি এক গুরুতর উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। সহযোগিতার জায়গা ক্রমে প্রতিযোগিতা ও বিদ্বেষে পরিণত হচ্ছে। বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে রয়েছে চার হাজার কিলোমিটারের বেশি দীর্ঘ সীমান্ত, যা শতাব্দীর প্রাচীন ইতিহাস, ভৌগোলিক, সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য এবং ভাষাগত যোগসূত্রে গভীরভাবে আবদ্ধ। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ভারত শুধু রাজনৈতিক মিত্র হিসেবে নয়, বরং অর্থনৈতিক সহযোগিতার অন্যতম প্রধান অংশীদার। বাণিজ্য কেবল অর্থনৈতিক বিনিময় নয় এটি কূটনৈতিক আস্থা ও পারস্পরিক সম্পর্কেরও প্রতিফলন। ফলে বাণিজ্যে টানাপোড়েন দেখা দিলে তা দুই দেশের আস্থা, সহযোগিতা এবং আঞ্চলিক স্থিতিশীলতার ওপর সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। যখন বৈশ্বিক বাণিজ্য পরিবেশ ট্রাম্পের রেসিপ্রোক্যাল ট্যারিফ নীতির কারণে অনিশ্চয়তায় ভুগছে, তখন দক্ষিণ এশিয়ায় পারস্পরিক সহযোগিতা আরও জরুরি হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশ ভারত বাণিজ্য উত্তেজনা ভবিষ্যতে বহুমাত্রিক প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে বলে ধারণা করা যাচ্ছে। গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব বিস্তার। বাংলাদেশ পাট উৎপাদনে ভারতের পর বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম দেশ হলেও কাঁচা পাট ও পাটজাত পণ্যের ক্ষেত্রে বিশ্বের সর্ববৃহৎ রপ্তানিকারক। হাজার হাজার কৃষক ও শ্রমিক পাট উৎপাদন ও প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে যুক্ত। বাংলাদেশ ও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্ক বাণিজ্যিক সহযোগিতাও একটি গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভে পরিণত হয়েছে। ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বাণিজ্যিক সম্পর্কের সূচনা হলেও দীর্ঘ সময়ে ধাপে ধাপে সম্পর্কের বিস্তৃতি লাভ করেছে। ২০১৫ সালের বাণিজ্যচুক্তির মাধ্যমে সীমান্ত হাট, ট্রানজিট সুবিধা এবং বন্দর ব্যবহারের নতুন সুবিধা যুক্ত হয়। ২০১৭ সালে সীমান্ত হাট স্থাপনের জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়। পাশাপাশি নৌপথ, রেলপথ এবং সড়কপথে সংযোগ বৃদ্ধির জন্য একাধিক চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়েছে। বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে সহযোগিতা বাড়াতে দ্বিপক্ষীয় একাধিক চুক্তি ও সমঝোতা হয়েছে, যা আঞ্চলিক সংযোগ যোগাযোগ ও টেকসই উন্নয়নে সহায়ক। দক্ষিণ এশিয়ার বৃহত্তর বাণিজ্যিক সংযোগের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ-ভারত পদক্ষেপ দুই দেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ককে আরও শক্তিশালী করেছে, আঞ্চলিক সহযোগিতার নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। ২০১১ থেকে ২০১৫ সালের মধ্যে ভারত ৬১টি বাংলাদেশি পণ্যে শুল্কমুক্ত ও কোটামুক্ত প্রবেশাধিকার দেয়, যার মধ্যে ৪৬টি তৈরি পোশাক পণ্য অন্তর্ভুক্ত ছিল। ইতিবাচক অগ্রগতিই পরবর্তী সময়ে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, সংযোগ ও কৌশলগত অংশীদারত্বের ভিত্তি তৈরি করে। ২০১৩ সালে দুই দেশের বিদ্যুৎ গ্রিড সংযুক্ত হওয়ার পর বাংলাদেশ ভারত থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে। আদানি গ্রুপের ঝাড়খন্ড প্ল্যান্ট (১,৪৯৬ মেগাওয়াট), বহরমপুর (১,০০০ মেগাওয়াট) এবং ত্রিপুরা (১৬০ মেগাওয়াট) বিদ্যুৎকেন্দ্র। এ ছাড়া খুলনায় নির্মিত ১,৩২০ মেগাওয়াটের রামপাল তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্রটি বাংলাদেশ-ভারতের যৌথ উদ্যোগে পরিচালিত হচ্ছে। বাণিজ্য সহযোগিতার পাশাপাশি ১৯৯৬ সালের গঙ্গা পানিচুক্তি এবং ২০১৫ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তির মতো গুরুত্বপূর্ণ দ্বিপক্ষীয় উদ্যোগসমূহ বাংলাদেশ ভারতের মধ্যে পারস্পরিক আস্থা পুনর্গঠনের পথ সুগম করেছে। ২০০০ সালের পর ভারত একতরফা ভাবে দক্ষিণ এশীয় মুক্ত বাণিজ্যচুক্তির আওতায় বাংলাদেশকে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার প্রদান করলে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যে নতুন গতি আসে। দেশীয় রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের সাথে ভারত সম্পর্কের চির ধরবে তা বাংলাদেশের জনগণ বিশ্বাস করে না। বাংলাদেশ-ভারত বাণিজ্য উত্তেজনার অর্থনৈতিক, কূটনীতিক ও আঞ্চলিক প্রভাব কমিয়ে দীর্ঘ সুসম্পর্ক আরও মজবুত হবে এমনটাই প্রতিবেদনের প্রত্যাশা।

আলোকিত প্রতিদিন/এপি

- Advertisement -
- Advertisement -