আজ মঙ্গলবার, ২১ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।   ৫ আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

জুলাই যোদ্ধাদের নতুন দেশ গড়ার প্রত্যয়

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

২০২৪ সালের জুলাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে কয়েকজন শিক্ষার্থীর আহ্বানে ‘কোটা সংস্কারের’ দাবিতে শুরু হয় আন্দোলন। প্রথমে ছিল ছোট পরিসরের বিক্ষোভ, পরে তা ‘আগুন’ হয়ে ছড়িয়ে পড়ে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে।

তৎকালীন সরকার এই আন্দোলন দমন করতে কঠোর অবস্থান নেয়। টিয়ারশেল, রাবার বুলেট, নির্যাতন, গুম— সবই প্রয়োগ করে। কিন্তু দমনের সেই নীতি বুমেরাং হয়ে ফিরে আসে। আন্দোলন পায় জনসমর্থন, ধীরে ধীরে রূপ নেয় গণআন্দোলনে। পতন হয় শেখ হাসিনা সরকারের। ৫ আগস্ট পরিণত হয় ইতিহাসের মোড় ঘোরানোর এক জীবন্ত ইতিহাস।

স্বৈরাচার হাসিনার পতনের এক বছর পার হচ্ছে। আজও অনেকে বলেন– ‘স্বপ্ন এখনো বেঁচে আছে, শক্তি হয়ে আছে’। আন্দোলনের রাজপথ ছেড়ে মানুষ জীবনের পথে ফিরলেও সেই দিনগুলো স্মৃতিতে গেঁথে রয়েছে, স্লোগানের শব্দ এখনো প্রতিধ্বনিত হচ্ছে মাথার ভেতরে। রাজনীতি, রাষ্ট্র, সমাজ-সবকিছু প্রত্যাশা অনুযায়ী না বদলালেও বদলেছে এ দেশের তরুণদের আত্মপরিচয়!

অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণেরা বলছেন, ‘প্রজন্মের অনুভূতি, প্রত্যয় ও অভিজ্ঞতার আলোকে তৈরি হয়েছে এক নতুন বাস্তবতা। যেখানে স্বপ্ন ভেঙে না পড়ে শক্তি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার সাহস জুগিয়ে যাচ্ছে।’

- Advertisement -

সবচেয়ে মানবিক দিক ছিল নারীদের অংশগ্রহণ। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক এবং বর্তমানে গণতান্ত্রিক ছাত্র সংসদের আহ্বায়ক আবু বাকের মজুমদার এ ঘটনাকে ‘গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের ফাইনাল আউটপুট’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছেন।

তিনি মনে করেন, ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের আন্দোলন নিছক রাজনৈতিক চাপ তৈরি করার প্রচেষ্টা ছিল না। বরং এটি ছিল একটি যুগান্তকারী গণঅভ্যুত্থান, যেখানে দেশের নাগরিক সমাজ ও তরুণ নেতৃত্ব একসঙ্গে নিজেদের চূড়ান্ত অবস্থান স্পষ্ট করেছিল।

‘তরুণ প্রজন্ম এই আন্দোলনের নেতৃত্বে এসেছে। তারা জীবনবাজি রেখে, ভয় উপেক্ষা করে রাজপথে দাঁড়িয়েছে। এই সাহসিকতা, এই আত্মত্যাগ কোনোদিন হারিয়ে যাবে না।

তার মতে, নেতৃত্বের ধারণাটাও এই আন্দোলনের মধ্য দিয়ে পাল্টে গেছে। কারণ, এখন আর নেতৃত্ব মানে শুধু বক্তৃতা দেওয়া নয়; নেতৃত্ব মানে মাঠে থাকা, ঝুঁকি নেওয়া, সাধারণ মানুষের পাশে দাঁড়ানো। এই তরুণ নেতৃত্ব ইতিহাসে নিজেদের জায়গা তৈরি করে নিয়েছে।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম এ সমন্বয়ক আরও বলেন, “এই আন্দোলনে নারী, ধর্মীয় সংখ্যালঘু, ভিন্ন মতাবলম্বীসহ সমাজের প্রায় সব স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল অসাধারণ। এমন বৈচিত্র্য বাংলাদেশে আগে দেখা যায়নি। ফলে এটিকে আমরা নিছক ছাত্র আন্দোলন বলতে পারি না, এটি ছিল ‘জনগণের অভ্যুত্থান’।”

আন্দোলনের সময়কার কিছু স্মৃতি আজও আবু বাকের মজুমদারকে আলোড়িত করে। তার ভাষায়, ‘আমরা সবাই তখন একটা পরিবার হয়ে গিয়েছিলাম। ধর্ম, বর্ণ, রাজনৈতিক মতাদর্শ, এমনকি ক্যাম্পাসভিত্তিক পরিচয়— কিছুই আমাদের আলাদা করতে পারেনি। আমরা একে-অপরকে আগলে রেখেছি, একে-অপরের পাশে দাঁড়িয়েছি। আমরা এমন একটি কমিউনিটিভিত্তিক আন্দোলন পরিচালনা করেছিলাম, যেখানে নেতৃত্ব কেবল বক্তৃতার মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। পোস্টার হাতে, মিছিলের অগ্রভাগে, মাইক হাতে— সব জায়গাতেই নেতৃত্ব ছিল।

আন্দোলনে নারীদের স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণ তরুণ এই জুলাই যোদ্ধাকে সবচেয়ে বেশি আবেগপ্রবণ করে। বলেন, ‘অনেক মেয়ে প্রথম সারিতে দাঁড়িয়ে পুলিশের চোখে চোখ রেখে প্রতিবাদ করেছে। পিছু হটেনি। তারা ইতিহাসে আলাদা সম্মান পাবে।’

শেখ হাসিনার স্বৈরাচারী শাসনের অবসান—বড় অর্জন। গণঅভ্যুত্থানের এক বছর পূর্তিতে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তি এবং দেশের সামগ্রিক পরিবর্তনের প্রেক্ষাপট নিয়ে ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক নাজমুল হাসান বলেন, ‘৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থান-পরবর্তী এক বছরে আমাদের সবচেয়ে বড় অর্জন হলো— এই দেশ থেকে শেখ হাসিনার মতো একজন স্বৈরাচার, ভারত-অনুগত শাসনের অবসান ঘটানো। আমরা বহু বছর ধরে একটি দমন-পীড়নমূলক শাসনব্যবস্থার মধ্যে থেকেছি, যেখানে একটা পোস্টার টানানো, একটা প্রতিবাদ সমাবেশ করা মানেই ছিল রিমান্ড, গুম কিংবা বিচারবহির্ভূত হত্যার ভয়। সেই বাস্তবতা থেকে আজ অন্তত আমরা মুক্তভাবে নিশ্বাস নিতে পারছি।’

তবে, সব অর্জনের মধ্যেও সবচেয়ে বড় অপ্রাপ্তির জায়গা হলো– আন্দোলনের সময় সংঘটিত হত্যার বিচার। এক বছর পার হতে চললেও কোনো মামলার বিচার শেষ হয়নি। কয়েকটি মামলার আদেশই আসেনি। ‘এটা ব্যথার’— বলেন নাজমুল। ‘আবার সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে, তাও বলা যাচ্ছে না। আমরা যে স্বপ্ন ও প্রত্যাশা নিয়ে রাজপথে নেমে ছিলাম, তার অনেকগুলো এখনো অপূর্ণ রয়েছে।’

ছাত্র অধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক বলেন, ‘আমরা বারবার বলে এসেছি, ছাত্র রাজনীতির সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে হলে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে ছাত্র সংসদ নির্বাচন জরুরি। এ বিষয়ে কিছুটা অগ্রগতি হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে নির্বাচন আয়োজন নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে, যেটা ইতিবাচক দিক। তবে, এটা এখনো সর্বজনীন বাস্তবতা হয়ে ওঠেনি। শুধু আলোচনা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে চাই।’

‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে কিছুটা শঙ্কাও কাজ করে’— উল্লেখ করে নাজমুল হাসান বলেন, ‘ভারতে বসে শেখ হাসিনা এখনো রাজনৈতিক হুমকি দিচ্ছেন। গোপালগঞ্জে আওয়ামী লীগের ক্যাডারদের নতুন করে সংগঠিত করে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। এর মধ্যে একজন মেজরের সম্পৃক্ততাও পাওয়া গেছে। এই পরিস্থিতি আমাদের রাষ্ট্রের জন্য অশনি সংকেত। বিশেষ করে যারা গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দিয়েছেন, শহীদ পরিবার— সবাই এখন চরম নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সেজন্য আমি প্রধান উপদেষ্টা ও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করব, নেতাকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে আরও বেশি সচেষ্ট হবেন তারা।  এখন সেই অর্জন টিকিয়ে রাখাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।’

‘এখন অনেকেই হতাশ হয়ে পড়েছেন, থেমে গেছেন। কিন্তু কিছু মানুষ এখনো দৃঢ়ভাবে দাঁড়িয়ে আছেন। আমি থামিনি, কারণ আমি তাদের দেখি। সেই সাহসই আমাদের স্বপ্নকে টিকিয়ে রেখেছে।’

নতুন বাংলাদেশের এক বছর পূর্তির বিষয়ে জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য আব্দুল মুনঈম বলেন, ‘আমার চোখে বাংলাদেশ বদলেছে। কিন্তু এটা শুধু চোখে দেখা কোনো দৃশ্য নয়, এটা মানসিক এক জাগরণ। যে প্রজন্ম একসময় নিঃশব্দ ছিল, তারা আজ প্রশ্ন তোলে, অধিকার চায়। তারা রাজনীতিকে চ্যালেঞ্জ করে। হয়তো প্রশাসনিক কাঠামো এখনো একই আছে কিন্তু জনগণের মধ্যে একটা চেতনার বীজ অঙ্কুরিত হয়েছে। এটাই ৫ আগস্টের সবচেয়ে বড় অর্জন।

‘ভবিষ্যতে এই দিনটিকে শুধু প্রতিবাদের দিন হিসেবে নয় বরং জাতি-জাগরণের প্রতীক হিসেবে স্মরণ করা হোক’— প্রত্যাশা এই এনসিপি নেতার। বলেন, ‘৫ আগস্ট আমাদের মনে করিয়ে দিক— কোনো অন্যায় চিরকাল টিকে থাকে না আর কোনো স্বপ্ন একা থাকে না। যারা সাহস করে রাস্তায় নেমেছিল, তারা শুধু নিজ অধিকারের জন্য নয়, পুরো জাতির ভবিষ্যতের জন্য আওয়াজ তুলেছিল। এই দিন একদিন জাতীয় ইতিহাসে আলোকবর্তিকার মতো বিবেচিত হবে।’

মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিল। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের কেন্দ্রীয় কমিটির সাংগঠনিক সম্পাদক মুঈনুল ইসলামের মতে, গত এক বছরের সবচেয়ে বড় অর্জন হচ্ছে ‘গণমানুষের ঐক্য’। তার ভাষায়, ‘মানুষ ঐক্যবদ্ধ ছিল। আন্দোলনের সময় এত বড় উত্তেজনা, সহিংস পরিস্থিতির পরও দেশে গৃহযুদ্ধের মতো পরিস্থিতি তৈরি হয়নি। এটিই আমাদের বড় বিজয়।’

‘রাষ্ট্রযন্ত্রের পক্ষ থেকে বিগত বছরগুলোতে যে মাত্রায় দমন-পীড়ন চলেছে, সেই তুলনায় গত এক বছরে তুলনামূলক সহনশীল পরিবেশ তৈরি হয়েছে। গণতান্ত্রিক পরিবেশ পুরোপুরি তৈরি না হলেও কিছুটা তৈরি হয়েছে– এটাই আমাদের লড়াইয়ের ইতিবাচক দিক। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো— বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও মতের মানুষ এখন টেবিলে বসে আলোচনা করছেন, মতবিনিময় করছেন।’

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের এই নেতা বলেন, ‘প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির বিচার আপেক্ষিক। সফলতা ও ব্যর্থতা— দুটোই আন্দোলনের অংশ। জুলাই-পরবর্তী বাংলাদেশকে আমরা যেমন দেখতে চেয়েছিলাম, সেটি পুরোপুরি বাস্তবায়ন হয়নি, ঠিকই। তবে, রাষ্ট্রগঠনের একটি নতুন প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।’

‘আমরা কিন্তু হতাশ নই। কারণ আমরা জানি, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার অবসান এবং নতুন এক বন্দোবস্ত গঠনের জন্য সময় লাগে, নিষ্ঠা লাগে। আমরা সেই পথেই রয়েছি। পরিবর্তনের যে বীজ আমরা বপন করেছি, তার অঙ্কুর ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে। মানুষ বিশ্বাস ফিরে পাচ্ছে, প্রশ্ন করছে, যুক্তির দিকে ফিরছে— এটাই আমাদের শক্তি।’

আলোকিত প্রতিদিন/০৫ আগস্ট ২০২৫/মওম

- Advertisement -
- Advertisement -