আশিকুল কাদির:
দম বন্ধকরা নিদ্রাহীন রাতের কোলে হেলান দিয়ে মানুষ প্রহর গুনছিলো কবে কখন দূর হবে ঘোর অমানিশা। মানুষ দিনে দিনে বছরের পঞ্জিকার দিকে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে ক্লান্তিকর দুর্বিসহ সময়ের গিঁট ছেঁড়ার জন্যে ছিলো উদগ্রীব আর দুর্ভাবনামুক্ত একটি সূর্যোদয়ের অপেক্ষায় ম্লান মুখে তাকিয়ে থাকতো উর্ধাকাশে ওই সৃষ্টিকর্তার কৃপার আশায়। এমনি করেআপামর জনতা আর রাষ্ট্রের অন্যসব সংস্থার একটি বৃহৎ অংশ নিজেদের দুঃসহ জীবন নিয়ে ভেঙ্গে পড়ছিলো। বাংলাদেশের আকাশের কালো মেঘ এবং ঝড়ের অগ্রিম শঙ্কা থেকে মুক্তির কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছিলো না অলৌকিক কোনো সাহায্য ছাড়া। তখন নির্যাতিত মানুষের সাথে সহমর্মিতার গোপন আত্মার সম্পর্ক নিবিড়ভাবে তৈরি করে ছাত্র তরুণ এবং সেনাবাহিনীর দেশপ্রেমিক সদস্যগণ।
যারা শান্তিপ্রিয় এবং নিজেদের মুক্তির পথ খুঁজে প্রায় ব্যর্থ-হতাশ কিন্তু ভেতরে তাদের অগ্নিরূপতার অন্তর্নিহিত কারণ অনুধাবন না করেই সরকার প্রধান এবং ফ্যাসিবাদপুষ্ট কতিপয় কর্তৃত্ববাদী অগণতান্ত্রিক মন্ত্রীগণওদম্ভভরে মিডিয়ায়, সভায়, সেমিনারের বারবার প্রচার করতে থাকে যে–এই দেশে তাদের কোনো বিকল্প নেই। অতো উন্নয়ন বর্হিবিশ্বের সকল রাষ্টনেতা বুঝে কিন্তু দেশের অভ্যন্তরে অন্যসব বিরোধীরা বুঝে না। (যদিও তারা কেবল ভারতকেই বহির্বিশ্ব মনে করতো) এসব তারা জায়েজ করেছে একনায়কতান্ত্রিক স্বৈরশাসনের ফর্মূলায়,জাতীয় ও উপনির্বাচনে মামা-ভাগ্নের নির্বাচনের মাধ্যমে, ভোটার বিহীন বিজয় দেখিয়ে। বিরোধীদলহীন প্রহসনমূলক নির্বাচনের বিষয়ে জাতিসংঘ ও বিশ^মিডিয়া অবগত হবার পরেও তাদের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞাকেও ফ্যাসিবাদী সরকার দম্ভভরেডিজ‘অনার করেছে। এভাবেই ফ্যাসিবাদী শক্তি বছরের পর বছর জগদ্দল পাথরের মতো চেপেছিলো জনমানুষের ঘাড়ে।
তবে শেষ সময়ে ভোট ডাকাতিসহ প্রশাসনের ভেতর নিজেদের লোক রেখে বিচার ব্যবস্থা ও পুলিশদেরচরমভাবে দলীয়করণ করেও শান্তিতে ঘুমাতে পারেনি ক্ষমতাসীন দুর্বৃত্তগণ। উজাগর রাত কাটাতে হয় তাদেরও কারণ দুর্নিতি এবং বিশাল অঙ্কের অর্থ পাচারের সাথে সংশ্লিষ্ট থাকে যারা, সাধারণত পাপের ভূত সেসব মানুষকে তাড়িয়ে বেড়ায় আর মানসিক অস্থিরতায় কাতর করে তোলে। এছাড়া ব্যাংক লুট শেয়ার বাজার কেলেঙ্কারি দ্রব্যমুল্য উর্ধ্বগতি বিদ্যুতের মতো স্পর্শকাতর সেক্টরগুলোকে কাগুজে বাঘ বানিয়ে নিজের পকেট ভারি করেছে বছরের পর বছর। বিরোধীদের হত্যা গুম জেল রিমান্ডে নিয়ে অত্যাচারের মাত্রাকে ভারি করে তোলা। এসব কারণ দিনে দিনে বছরে পুঞ্জিভূত হয়ে মানুষের মনে, তৈরি হয়েছে অপ্রতিরোধ্য ক্ষোভের আগুন। ফ্যাসিবাদীরা এসব চোখে দেখে না। তারা ক্ষমতার লোভের কালো চশমায় অন্যদের কষ্ট অবলোকন কওে না বলেই এক সময় ঘটে বিপত্তি।
আসলে অপ্রতিরোধ্য সংগ্রাম আর বিশ্বাস মানুষকে আশাবাদী করে এক সময়। জুলাই-আগষ্টের রক্তাক্ত সংগ্রাম ও ত্যাগ মানুষের দৃঢ় চেতনাকে বিজয় এনে দিয়েছে এভাবেই। প্রকৃত দেশপ্রেম আর রক্তঝরা ত্যাগ কখনো বিফলে যায় না। পৃথিবীর অন্যান্য দেশেও ন্যায্য অধিকার আদায়ের সংগ্রামগুলো এভাবেই সফলতায় পর্যবসিত হয়েছে। ইতিহাস তাই প্রমান করে। বাংলাদেশে যেই মানুষ আগষ্টকে “শোকের” মাস মনে করতো সেই মানুষরা আগষ্টকে এখন “সুখের” মাস ভাবতে শুরু করেছে। একটি আন্দোলন একটি বিপ্লব একটি নাটকীয় সংগ্রাম কীভাবে অগি্নাগিরির দাবানলে সব ভাসিয়ে দিলো তার জ¦লন্ত স্বাক্ষী হলো আগষ্ট বিপ্লব।
নতুন স্বাধীনতার এই স্বাদ বুঝতে পেরেছে বর্তমান তারুণ্য। তাদের সাথে দীর্ঘকাল ফুঁসতে থাকা নিপীড়িত মানুষগণ স্বৈরশাসকের মসনদকে ভেঙ্গেচুড়ে তছনছ করেই ছাড়লো। দেশের ছাত্র সমাজ বা জনতা মূলত কেবলমাত্র একজন ব্যক্তিকেই ক্ষমতা থেকে উচ্ছেদ করবার সংগ্রামে লিপ্ত হয়নি বরং এই সংগ্রাম ছিলো মূলত বদলে দেবার সংগ্রাম, যাতে করে আর কখনো স্বৈরাচারের সৃষ্টি না হয়। এই সংগ্রাম ছিলো আর যেনো দুর্নিতির সৃষ্টি না হয় আর যেনো পুলিশি রাষ্ট না হয়। বিচার ব্যবস্থা যেনো স্বাধীন থাকে–তাই ছিলো ছাত্র জনতার পরম আরাধ্য এক চাহিদা।
ছাত্রদের যৌবনের কালকে, তাদের রক্তধারাকে ফ্যাসিবাদী সরকার বুঝে উঠতে পারেনি। তারুণ্যের ভেতরে অদৃশ্য এক ক্ষমতা থাকে যা একবার জ¦লে ওঠলে নেভানো কঠিন। তাই তরুণের অপ্রতিরোধ্য আওয়াজে যখন কেঁপে ওঠলো দেশের সমস্ত অলিগলি গ্রাম রাজপথ তখনই মুলত নতুন এই স্বাধীনতার সংবাদ সাধারণ জনতার চিন্তায় প্রবেশ করে। তখন আর বসে থাকেনি রিকশাওয়ালা, বাদামওয়ালা, কেরানী, পিওন, গার্মেন্ট কর্মী, জেলে, কুমার, পথচারি। সবাই মিলিত হয়েছে এক মোহনায়।
৭১ এর একটি ত্যাগের মহিমাতো ছিলোই মানুষের মনে কিন্তু এটির সাথে জুলাইয়ের রক্ত মিলে একাকার হলো নতুর বিজয়ের নেশায়। গর্জে ওঠা নতুন শব্দে শব্দে শ্লোগানে ম্লোগানে প্রকম্পিত হলো রাজধানী, রাজধানী দখলই যেনো মূল টার্গেট ছিলো ছাত্র জনতার, টার্গেটে ছিলো ফ্যাসিবাদীর আসল আয়নাঘর বলে বিবেচিত গণভবন। তথ্যমতে পয়তাল্লিশ মিনিটের বিপ্লবই সব কিছু তছনছ করে বিজয়ের পতাকায় হাত মিলিয়ে নিলো সেনাবাহিনীও। তাঁরা মনে করিয়ে দিলো জাতির দুঃসময়ে সত্যি অকুতোভয় সেনারা বেইমানি করে না।
পরিশেষে যে কথা বলা আবশ্যক তা হলো বিশ্বাস আর সততার মিশেলে যে সংগ্রামের বীজ অঙ্কুরিত হয় তাতে স্বৈরাচার ফ্যাসিবাদীর পরাজয় অবশ্যম্ভাবী। ফ্যাসিষ্টদের এই চরম পরিণতি সম্পর্কে যুগ যুগে সকল রাজনীতিবিদগণ স্বরণে রাখবেন–এটাই হউক বিজয়ের আরেক সবক।
আশিকুল কাদির
সিনিয়র সাব এডিটর
দৈনিক আলোকিত প্রতিদিন