দ্বীন মোহাম্মাদ দুখু:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনের সময় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের (জবি) শিক্ষার্থীদের ওপর পিস্তলের গুলি ছুঁড়ে নতুন আলোচনায় আসেন ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের ৪৩ নম্বর ওয়ার্ড সাবেক কাউন্সিলর, ওয়ার্ড আওয়ামী লীগ নেতা ও বাপুসের সাবেক সভাপতি আরিফ হোসেন ছোটন।
বাংলাবাজারের প্রকাশকদের ওপর অন্যায্য ও মনগড়া সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়া ও ১৬ বছর বিনা নির্বাচনে জোরপূর্বক বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতির পদ দখলে রাখাসহ নানা অপরাধমূলক কাজ এবং কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে আরিফ হোসেন ছোটনের বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে গেলে বাংলাবাজারের একাধিক প্রকাশক মুখ খোলেন। তারা জানান, এরশাদ আমলে আলমগীর শিকদার লোটন যখন ছাত্রসমাজের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি, তখন ছোটনের ভাই সারোয়ার হোসেন টিটো ছিলেন সাধারণ সম্পাদক। তখন আরিফ হোসেন ছোটনকে ভোট ছাড়াই পুস্তক প্রকাশনা সমিতির ঢাকা মহানগর কমিটির সাধারণ সম্পাদক বানান লোটন ও টিটো। এ ঘটনায় শহিদ নামে একজন প্রতিবাদ করেন। কিছুদিন পরই আততায়ীর গুলিতে মারা যান তিনি। তখন প্রকাশকদের মুখে-মুখে এ খুনের ঘটনায় ছোটনের নাম আসে। অভিযোগ রয়েছে, সময়ের পরিক্রমায় আরিফ হোসেন ছোটন ভোটারবিহীন এক নির্বাচনে পুস্তক প্রকাশনা সমিতির সভাপতি হন। সমিতির গঠনতন্ত্র অনুযায়ী ভোটের মাধ্যমে পরপর দুই দফায় সর্বোচ্চ চার বছর পদে থাকার বিধান থাকলেও তিনি সেটা মানেননি। এ নিয়ে কোনো প্রকাশক প্রতিবাদ করলে তার দোকানে তালা মেরে দেয় ছোটনের লোকজন। তার অনুসারীদের অত্যাচারের কারণে একুশে প্রকাশনীর মিজানসহ বেশ কয়েকজন বাংলাবাজার ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। এ ছাড়া প্রকাশকদের তার কাছ থেকে কাগজ কিনতে বাধ্য করারও অভিযোগ আছে তার বিরুদ্ধে।
অনুসন্ধানে উঠে আসে, বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতির সভাপতির নাম ভাঙিয়ে আরিফ হোসেন ছোটন বাড়ি ও মার্কেট দখল, চাঁদাবাজি, মাদক ব্যবসা, হেরিটেজখ্যাত লালকুঠির জায়গায় অবৈধ দোকান নির্মাণ করেন।
সরেজমিন ঐতিহ্যবাহী লালকুঠির পেছনে গিয়ে দেখা যায়, কুঠির জায়গায় বেশ কয়েকটি দোকান বানিয়ে ভাড়া দেন ছোটন। এলাকাবাসীর অভিযোগ, এসব দোকানের পজিশন বিক্রি করে কয়েক কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তিনি।
স্থানীয়রা জানান, ফরাশগঞ্জ রোডে কাশ্মীরি হাউস নামে একটি বিলেতি মদের দোকান ছিল। ছোটন কাউন্সিলর ও বাপুস সভাপতি হওয়ার দাপটে হয়ে সেই দোকানটা তুলে দেন। এর পরপরই ওই এলাকায় ইয়াবা-ফেনসিডিলের মতো ভয়াবহ মাদকের ব্যাপক বিস্তার ঘটান তিনি।
স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, বাংলাবাজার এলাকার চাঁদাবাজ সবাই আরিফ হোসেন ছোটনের অনুসারী। বাদামতলী ঘাট থেকে ওয়াইজঘাট পর্যন্ত এলাকায় তারা চাঁদাবাজির সঙ্গে জড়িত। সদরঘাট এলাকায় চাঁদাবাজি করে খলিফা বাহিনী। অনুসারী চাঁদাবাজদের কাজ হলো- পুস্তক ব্যবসায়ীদের চাপ দেওয়া ও জোরপূর্বক মাসিক চাঁদা আদায় করা। চাপের মুখে শ্যামবাজার ব্যবসায়ী বণিক সমিতিকে প্রতিদিন ৭৫ হাজার টাকা দিতে হতো ছোটনকে। এমনকি শ্যামবাজার পাইকারি মার্কেটে যত ট্রাক পণ্য যায়, প্রতি ট্রাকে দেড় হাজার টাকা চাঁদা দিতে হয়। বাদ যায়নি বাংলাবাজারের পান ব্যবসায়ীরাও। তাদের কাছ থেকেও গাড়িপ্রতি ৫০০ টাকা ও ভ্যানপ্রতি ১৫০ টাকা চাঁদা তুললো ছোটনের অনুসারী চাঁদাবাজরা।
পুরান ঢাকার বাসিন্দারা জানান, ২৫, পিসি ব্যানার্জি লেনের এক বাড়িওয়ালাকে কয়েক বছর বাড়িতে ঢুকতে দেননি ছোটন। পরে সাত কাঠা ভূমির ওপর আনুমানিক পাঁচ কোটি টাকা মূল্যের পাশাপাশি ওই দুটি বাড়ি কেনেন মাত্র ৪০ লাখ টাকায়। সেখানে বহুতল ভবন তুলেন ছোটন।
এছাড়া, ২৯, বাংলাবাজারের মেহেরজান হোটেলের জায়গা নিয়ে দু’পক্ষের বিরোধ ছিল। এই বিরোধকে কাজে লাগিয়ে সে জমির মালিক হয়ে গেছেন ছোটন। সেখানে তার মালিকানাধীন ডেভেলপার প্রতিষ্ঠান রয়েল ডিজাইন প্রপার্টিজ লিমিটেড বহুতল ভবন নির্মাণ করছে। ২২ নম্বর পাতলা খান লেনে ছোটনদের ছিল পুরনো বাড়ি। বাড়ির পেছনে কিছু সরকারি প্যাসেজ ছিল। বাপুস সভাপতি হয়ে সেখানে ১০ তলা অত্যাধুনিক ভবন তৈরি করেছেন ছোটন। বাড়ি তৈরির সময় দখল করে নিয়েছেন প্যাসেজটি। এ ছাড়া ১৬, কেজি গুপ্ত লেনে একটি মন্দিরের জায়গা দখল করে জেনারেটর ব্যবসা করছেন বলেও অভিযোগ রয়েছে ছোটনের বিরুদ্ধে।
এদিকে, সদরঘাট এলাকায় বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলন চলাকালীন রিক্সাচালক রিপন হত্যায় রাজধানীর কোতয়ালি থানায় মামলাসহ ২০টির অধিক মামলা দায়ের করা হয়েছে আরিফ হোসেন ছোটনের বিরুদ্ধে ।
উল্লেখ্য, ১৯৯১ থেকে ১৯৯৬ সাল নাগাদ ছোটনের বিরুদ্ধে খুন-অস্ত্রবাজি-সন্ত্রাস-চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন অভিযোগের ৩২টি মামলা ছিল। অস্ত্র ও চাঁদাবাজির একটি মামলায় তার সাত বছরের কারাদণ্ডও হয়েছিল। কিন্তু ১৯৯৪ সালের দিকে তিনি আওয়ামী লীগে যোগ দেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করে। এর পর তার সব মামলা একে একে প্রত্যাহার হয়ে যায়। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বিচারপতি সাহাবুদ্দীন আহমদের সাধারণ ক্ষমার আওতায় মওকুফ হয় সাত বছরের দণ্ডাদেশ।