এম. আর. কমল: কী যেনো এক অজানা আশংকায় নিজের দেশে এবং নিজের জন্মভূমিতেই সদ্মব্যর্থ সরকার ও তার অনুসারীদের কাছে তিনি ছিলেন নিন্দিত। আশংকাটা হয়তো ছিলো এরকম, তারা বলতো- ‘মুজিব মানেই বাংলাদেশ’। কিন্তু বিষয়টা যখন এরকম হতে চলেছে যে- ‘ইউনূস মানেই বিশ্ব’। তখন ইউনূস মুজিবকেও ছাপিয়ে যান। হাসিনা রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে পার্বত্য শান্তি চুক্তি করেও শান্তিতে নোবেল পান না। কিন্তু ইউনূস সমাজের প্রান্তিক শ্রেণীর মানুষদের নিয়ে একটি গরীবী ব্যাংক পরিচালনা করেই শান্তিতে নোবেল পান। বিষয়টি যেনো আর তাদের কাছে মেনে নেয়ার পর্যায়ে থাকে না।
অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস ছিলেন শিক্ষকতা পেশায়। সেখান থেকে প্রতিষ্ঠা করেন গ্রামীণ ব্যাংক। পরে ওই ব্যাংককে সাথে নিয়ে শান্তিতে নোবেল পুরস্কার অর্জন করেন তিনি । সেই থেকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে বিশ্বেও সুনাম ছড়িয়ে পড়ে তাঁর। একদিকে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের খ্যাতি বিশ্বব্যাপী ছড়াতে থাকে অন্যদিকে হাসিনার অন্তরজ্বালা বৃদ্ধি পেতে থাকে। যদিও নোবেল পাওয়ার পর অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসকে দেশের পক্ষে আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম অভিনন্দন জানিয়েছিলো।
কিন্তু নিজ দেশেই গত দেড় দশকেরও বেশি সময় ধরে তাঁকে নাজেহাল করা হয় চরমভাবে। কেড়ে নেয়া হয় তাঁরই প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংকের কর্তৃত্ব। নোবেল পুরস্কার অর্জনের মাত্র পাঁচ মাসের মাথায় রাজনৈতিক দল গঠনের কার্যক্রম করে সবাইকে অবাক করে দিয়েছিলেন অধ্যাপক ইউনূস।
২০০৭ সালে সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা ও বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে রাজনীতি থেকে সরাতে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ বেশ আলোচনায় ছিল। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের মাধ্যমে শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। ‘মাইনাস টু’ ফর্মুলার পেছনে অধ্যাপক ইউনূসকে একজন মাস্টারমাইন্ড হিসেবে ভাবতে শুরু করেন শেখ হাসিনা। সেই তো হলো শুরু, অধ্যাপক ইউনূসের পেছনে লেগে পড়লেন তিনি। কেড়ে নিলেন গ্রামীণ ব্যাংক। হয়রানীমূলক নানা ধরণের মামলা দিতে শুরু করলেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনা সরকার গঠনের পর গত দেড় দশকের বেশি সময় ধরে বিভিন্ন মামলায় আদালতে বারবার হাজিরা দিতে হয়েছে অধ্যাপক ইউনূসকে। গ্রেপ্তারের আশঙ্কায়ও ছিলেন তিনি।
ওয়ান-ইলেভেনে অধ্যাপক ইউনূস: ২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি সেনাবাহিনীর সমর্থনে এবং ফখরুদ্দিন আহমদের নেতৃত্বে তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠিত হয়। তখন সেনাপ্রধান ছিলেন জেনারেল মইন ইউ আহমেদ। তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান ফখরুদ্দীন আহমেদ এবং সেনাপ্রধান উভয়ে মিলে ‘মাইনাস টু ফর্মুলা’ নামে একটি তত্ত্ব বাস্তবায়ন করতে চেয়েছিলেন। যেখানে ‘বিএনপি ও আওয়ামী লীগ নেত্রীদ্বয়কে নির্বাসিত বা বন্দী রেখে নতুন একটি সরকার গঠন করে রাষ্ট্র পরিচালনা করার পরিকল্পনা ছিলো। সে সময়কার সেনাবাহিনী অধ্যাপক ড. ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রধান হবার দায়িত্ব নিতে বলেছিলেন। তবে তিনি তা নাকচ করে দিয়েছিলেন। এমন পরিস্থিতিতে নাগরিক শক্তি নামে একটি দল গঠনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন তিনি। পরবর্তী সেই প্রক্রিয়া থেকেও সরে এসেছিলেন অধ্যাপক ইউনূস। গত মার্চে বিবিসি বাংলায় দেয়া একটি সাক্ষাৎকারে তিনি জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দল গঠনের এই উদ্যোগ বা সিদ্ধান্ত ভুল ছিলো।
আওয়ামী লীগের সাথে বৈরিতার কারণ: ২০০৬ সালে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস যখন নোবেল পুরস্কারে ভূষিত হলেন তখন একই সাথে গ্রামীণ ব্যাংকও পেয়েছিল নোবেল পুরস্কার। অধ্যাপক ইউনূস ও তার প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণ ব্যাংক নোবেল পুরস্কার অর্জন করায় সে সময় বিরোধী দলে থাকা আওয়ামী লীগ সবার আগেই শুভেচ্ছা জানিয়েছিল। তবে ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর অধ্যাপক ইউনূসের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ করতে থাকে দলটি এবং তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যার প্রথমটা শুরু হয় গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অব্যাহতি দেয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১১ সালের ২মার্চ গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে অধ্যাপক ইউনূসকে অব্যাহতি দিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংক আদেশ জারি করে। এর বিরুদ্ধে ড. ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নয়জন পরিচালক দু’টি রিট মামলা করেছিলেন। দু’টি রিট আবেদনই খারিজ করে দিয়ে হাইকোর্ট ড. ইউনূসকে তাঁর পদ থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আদেশ বহাল রাখে।
পরে ওই বছরের ১২ মে ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদ থেকে ইস্তফা দেন অধ্যাপক ইউনূস। ক্ষমতায় আসার পরই পদ্মাসেতু তৈরিতে প্রকল্প প্রস্তুত করে হাসিনা সরকার। সে সময় অর্থায়নে রাজিও হয় বিশ্ব ব্যাংক। কিন্তু মাঝপথে সেই অর্থায়ন আটকে যায় দুর্নীতির অভিযোগে। এরপর বিভিন্ন সভা-সমাবেশে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা অভিযোগ তোলেন অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস প্রভাবিত করার কারণেই আটকে গিয়েছিলো পদ্মাসেতুর অর্থায়ন।
মার্চে বিবিসি বাংলাকে দেয়া সাক্ষাৎকারে এ ব্যাপারে অধ্যাপক ইউনুস বলেন, “আমার বাধা দেয়ার তো কোনও কারণ নাই। বিশ্ব ব্যাংক তো আমার প্রভাবিত করার জন্য অপেক্ষা করে নাই। তারা তো বলছে দুর্নীতি হয়েছে”। এই সময় অধ্যাপক ইউনূসের প্রতিষ্ঠিত গ্রামীণের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের দুর্নীতির অভিযোগ তুলে তার বিরুদ্ধে আরো কিছু মামলা করা হয়। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর কয়েকটি মামলায় খালাস দেয়া হয়েছে তাঁকে।
বৃটিশ ‘ল’-তে নাকি ‘জাষ্টিস অব ন্যাচার’ বলে একটি শব্দ আছে। এ বিষয়ের ব্যাখ্যাটি হলো এরকম যে, আদালতে বিচারক বুঝতে পারছেন আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো ব্যক্তিটি অপরাধী কিন্তু উপযুক্ত স্বাক্ষ্য প্রমাণের অভাবে তাকে সাজা দিতে পারছেন না তিনি। তখন তিনি তাকে মুক্তি দেন জাষ্টিস অব ন্যাচার বলে। বিষয়টি সত্যি হোক বা মিথ্যা; তাতে কিছু যায় আসে না। চিরন্তন সত্যি জাষ্টিস অব ন্যাচার বা বিধাতার বিচার বলে যে একটা বিষয় আছে এটা আমাদের স্বীকার করতেই হবে। আর সেই বিচারেই অধ্যাপক ইউনূসের চরিত্রে স্বৈরাচারী সরকারের দেয়া কলঙ্কের সকল প্রলেপ মুছে গেছে। তিনি হয়েছেন নন্দিত। পেয়েছেন যথাযোগ্য সম্মান। তাঁর কাছে আমাদের প্রত্যাশা থাকবে সকল হিংসা বিদ্বেষ ভুলে গিয়ে দেশ ও জাতির কল্যাণে কাজ করবেন তিনি। এ দেশ ষোলো কোটি মানুষের দেশ। একজন হাসিনা মানেই বাংলাদেশ নয়। আজকের দিনে কোথায় হাসিনা? কী তাঁর পরিণতি?
আলোকিত/০৮/০৮/২০২৪/আকাশ