এস এম ওয়ালীউল্লাহ: মহরম হলো চন্দ্র মাসের একটি মাস। যাকে আমরা ইসলামিক বছরের প্রথম মাস হিসেবে জানি। এই মাস দিয়েই নতুন বছরের সূচনা হয়ে থাকে। ইসলামিক ক্যালেন্ডার চন্দ্রচক্রের উপর ভিত্তি করেই চলে থাকে। ইসলাম ধর্মে মহররম মাসকে পবিত্র রমজান মাসের পর সব থেকে পবিত্র মর্যাদা পূর্ণ মাস হিসেবে গণ্য করা হয়। কেননা এই মাস আল্লাহর মাস হিসেবে গণ্য। মহররম আরবি অথবা হিজরি বছরের প্রথম সম্মানিত মাস। এ মাসের মধ্যে রয়েছে এমন একটি দিন বা তারিখ যেদিন বা তারিখে আল্লাহ রাব্বুল আলামীন অনেক কিছু ঘটিয়েছেন। ভবিষ্যতেও ঘটাবেন। সে দিবস বা তারিখটি হচ্ছে মহরম মাসের দশ তারিখ। যা আশুরা হিসাবে মুসলিম জাহান জেনে আসছি। এ মাসের ১০ তারিখ আশুরা দিবসেই আল্লাহ জাল্লা শানুহু এ আসমান, জমিন, গ্রহ, নক্ষত্র লৌহ কলম সৃষ্টি করেন। আবার এ দিবসেই আরশে আজিমে অবস্থান করেছেন। একই দিবসে আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জত আমাদের আদি পিতা হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লামকে সৃষ্টি সহ অনেক ধরণের ঘটনা এদিনে ঘটিয়েছেন। যেমন এই আশুরাই আল্লাহ রাব্বুল আলামীন হযরত আদম আলাইহিস সাল্লামকে বেহেশতে প্রবেশ করান। আবার একই তারিখে আল্লাহ আদম ও হাওয়া আলাইহিস সালামকে বেহেস্ত হতে দুনিয়ায় প্রেরণ করেন। আবার একই তারিখে আদম ও হাওয়া আলাইহি ওয়াসাল্লাম দীর্ঘদিন পর আরাফার ময়দানে সাক্ষাৎ করান। এ দিবসেই দুনিয়ায় প্রথম হত্যার প্রচলন শুরু হয়। যা হযরত আদম আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর এক পুত্র কাবিল তার ভাই হাবিল আলাইহি ওয়াসাল্লামকে হত্যার মাধ্যমে। এদিনই হযরত নূহ আলাইহি ওয়াসাল্লামের মহাপ্লাবন সংগঠিত হয়। যা চল্লিশ দিন স্থায়ী হয়। একই দিবসে মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম আযরের ঘরে জন্মগ্রহণ করেন। একই তারিখে অত্যাচারী বেইমান শাসক নমরুদের অগ্নিকুণ্ড থেকে হযরত ইব্রাহিম আলাইহি ওয়াসাল্লাম সম্পূর্ণ নিরাপদে আগুন থেকে আল্লাহর ইচ্ছায় মুক্তি লাভ করেন। একই তারিখে নমরুদ পৃথিবী থেকে ধ্বংস হয়। এদিনে হযরত মুসা আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফেরাউনের কবল থেকে রক্ষা পান। হযরত আইয়ুব আলাইহিস সাল্লাম আশুরা দিবসের দীর্ঘ ১৮ বছর দুরারোগ্য ব্যাধি থেকে মুক্তি লাভ করেন। হযরত ইউনুস আলাইহি ওয়াসাল্লাম মাছের পেট থেকে মুক্তি লাভ করেন। খ্রিষ্ট ধর্মানুসারীদের মতে এই দিনে হযরত ঈসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম দুনিয়ায় আগমন করেন। এই একই তারিখে অর্থাৎ মহরম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা দিবসে মক্কার কাফেরদের অত্যাচার থেকে মুক্তি ও ইসলাম প্রচার-প্রসারের জন্য আল্লাহর আদেশে মানবতার মুক্তির মহান সেনানী আমাদের কলিজার টুকরা আল্লাহর হাবিব রাসুল কারিম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজ জন্মভূমি মক্কা থেকে মদিনায় হিজরত করেন। পরবর্তীতে একই দিবসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের দৌহিত্র মা ফাতেমা ও হযরত আলী কাররাম আল্লাহ ওয়াজহুর আদরের দুলাল বেহেস্তের যুবকদের সরদার হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু ৬৮০ খৃষ্টাব্দে দুরাচারী শাসক এজিদের নিকৃষ্ট সৈন্যদের হাতে কারবালার ময়দানে শাহাদাত বরণ করেন। উল্লেখ্য যে, বর্তমানে এদশীয় কিছু নামমাত্র আলেম এজিদকে নির্দোষ দাবি করেন এবং তার পক্ষে সাফাই গায়। এখানে একথা ভাববার কোনো সুযোগ নেই যে, এজিদের ইশারা ব্যতিরেকে হযরত মুহাম্মদ (স.)-এর নাতী, হযরত আলী (রা.) ও হযরত ফাতেমা (রা.) সন্তানকে হত্যা করার দুঃসাহস কেউ দেখাতে পারে না। সুতরাং এখানে এজিদ কোনো অবস্থাতেই নির্দোষ হতে পারে না। বর্ণিত আছে আবার একই দিবসে পৃথিবী ধ্বংস হবে। অতএব পৃথিবীর সৃষ্টি থেকে শুরু করে হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু এর শাহাদাত পর্যন্ত এই দিনে অনেক ঘটনা আল্লাহ রাব্বুল আলামীন ঘটিয়েছেন। তাই এই দিনের মর্যাদা অনেক। জাহিলি যুগে আরবরা মহরম মাসের ১০ তারিখ অনেক গুরুত্ব সহকারে পালন করতো। এই দিনে মক্কার কাফেরেরা রোজা রাখতো। কাবা ঘরকে নতুন করে সাজাতো এবং কাবার গিলাব পরিবর্তন করে নতুন গিলাপ লাগাতো। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম নিজেও আশুরার দিবসকে সম্মান করতেন এবং এই দিনে রোজা রাখতেন। হাদিস- হযরত আব্দুল্লাহ বিন আব্বাস রাদিয়াল্লাহু বলেন- “রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মদিনায় এসে দেখেন মদিনার ইহুদীরা এই দিনে রোজা পালন করছে অতঃপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইহুদিদেরকে জিজ্ঞাসা করলেন তোমরা কিসের জন্য রোজা পালন করছো? তখন তারা বলল- ‘এই দিনে হযরত মূসা আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও তার সাথীরা ফেরাউনের হাত থেকে রক্ষা বা মুক্তি লাভ করেছিল তাই আমরা রোজা পালন করছি।’ অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন- তোমাদের চেয়ে মূসা আলাইহিস সালামের ব্যাপারে আমরা আরো বেশি হকদার তাই আমরাও রোজা পালন করব। তবে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মহরম মাসে দুটি রোখার নির্দেশ দিয়েছেন। ৯ ও ১০ অথবা ১০ ও ১১ তারিখ। যাতে করে ইহুদিদের সাথে আমাদের রোজার সাদৃশ্য না হয় বা মিলে না যায়। রমজান মাসের রোজা ফরজ হওয়ার পূর্বেই আশুরা রোজা ফরজ ছিল। যা আল্লার রাসুল পালন করতেন। পরবর্তীতে যখন রমজানের রোজা ফরজ করা হলো তখন থেকে আশুরার রোজা ঐচ্ছিক হিসেবে গণ্য হলো। মহরম মাসের ১০ তারিখ বা আশুরা দিবসে আমাদের প্রথমত করণীয় হচ্ছে এ দিবসে রোজা পালন করা। কেননা হাদিস- হযরত আবু হুরায়রা রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন- রাসুল (সা.) বলেছেন- ‘আল্লাহর কাছে রমজানের পর মহররমের রোজা হলো সর্বশ্রেষ্ঠ’ (সহীহ মুসলিম এবং ৬২ নং হাদিস) ইফতার করানো: এ দিবসে যেহেতু অনেকেই রোজা পালন করে থাকে তাই যথাসাধ্য চেষ্টা করতে হবে রোজাদারকে ইফতার করানোর। যাতে করে দিবসে আল্লাহর কাছ থেকে অধিক পরিমাণ সওয়াবের অধিকারী হওয়া যায়। তওবা করা: এদিনে জরুরী হচ্ছে আল্লাহর কাছে ইবাদত বন্দেগি ও দান সদকার মাধ্যমে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাওয়া বা তওবা করা। হযরত আলী রাদিয়াল্লাহ থেকে বর্ণিত তিনি বলেন- “আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে জিজ্ঞাস করেন হে আল্লাহর রাসূল রমজান মাসের রোজার পর আপনি কোন মাসের রোজা রাখতে নির্দেশ করেন? উত্তরে আল্লাহর হাবিব সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন- ‘তুমি যদি রমজান মাসের পর রোজা রাখতে চাও তাহলে মহররম মাসের রোজা রাখো, কেননা মহরম মাস আল্লাহর মাস, এ মাসে এমন একদিন বা তারিখ রয়েছে যেদিন আল্লাহ রাব্বুল আলামিন অতীতে অনেকের তওবা কবুল করেছেন আর ভবিষ্যতেও অনেকের তওবা কবুল করবেন।’” (তিরমিজি শরীফ ৭৪১ নং হাদিস)। আজকাল মহররম মাসকে বা আশুরা দিবসকে উদ্দেশ্য করে পৃথিবীর কিছু কিছু দেশে যা করা হচ্ছে তা সঠিক ইসলাম সমর্থন করে না। তাই আমাদেরকে নিম্ন উল্লিখিত বিষয়গুলো বর্জন করতে হবে। যেমন মহরমকে উদ্দেশ্য করে ক্রন্দন বা বিলাপ করে বুক চাপড়ানো। এটা মহররমের বা আশুরা দিবসের শিক্ষা নয়। তাই এগুলো বর্জন করতে হবে। নিজেকে রক্তাক্ত করা: যেহেতু হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু কারবালায় রক্তাক্ত হয়েছিলেন, তাই কিছু কিছু অতি আবেগী ব্যক্তি নিজেকে আঘাতের মাধ্যমে রক্তাক্ত করেন। এগুলো করা যাবে না। শোক মিছিল, তাজিয়া মিছিল করা যাবে না। মর্সিয়া বা শোকগাথা পাঠ করা, মজলিসের আয়োজন করা ও এতে সওয়াবের উদ্দেশ্যে অংশগ্রহণ করা, বাদ্যযন্ত্র বাজানো, কালো সবুজ পোশাক পরিধান করে শোক প্রদর্শন ও হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর নকল কবর বানিয়ে মানুষ থেকে টাকা পয়সা উত্তোলন করা। এসব কিছুই বিদাত বা সম্পূর্ণ নাজায়েজ। মনে রাখতে হবে আশুরা কেবলমাত্র হযরত হোসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহুর কারবালার শহীদের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। বরং এ দিবসে পৃথিবীর সৃষ্টিলগ্ন থেকে অনেক ঘটনা আল্লাহ ঘটিয়েছেন এবং ভবিষ্যতেও ঘটাবেন। তাই আশুরাকে শুধুমাত্র কারবালায় সীমাবদ্ধ করা ঠিক হবে না। আশুরার শিক্ষা: মহরম মাসের ১০ তারিখ আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের কাছে অনেক গুরুত্ব বহন করে। তাই আমাদের উম্মতি মোহাম্মদীর উচিত হবে মহররম মাসের গুরুত্ব দেয়া। এ মাসে বেশি বেশি তওবা ও ইস্তেগফার করা। আল্লাহর প্রিয় বান্দা হওয়ার কর্ম করা। আমরা এ দিবস থেকে আরো যে শিক্ষা পাই; তা হলো অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা নত না করা, সর্বদা ন্যায় ও হকের পথে জীবন উৎসর্গ করা। হকের পক্ষে একা হলেও তা বুলন্দ করা, সর্বদা অন্যায়ের প্রতিবাদ করা, ন্যায়ের পথে অবিচল থাকা। যা কারবালায় হযরত হুসাইন রাদিয়াল্লাহু আনহু দেখিয়ে দিয়েছেন। সর্বশেষ আসুন আমরা আশুরা থেকে শিক্ষা নিয়ে নিজেদের ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করি ও মুক্তিপ্রাপ্তদের অন্তর্ভুক্ত হই। আল্লাহ যেন আমাদের সেই তৌফিক দান করেন, আমিন।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিষ্ট।
আলোকিত/১৬/০৭/২০২৪/আকাশ
আশুরার তাৎপর্য
-Advertisement-
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -
- Advertisement -