কবি অসীম সাহা স্মরণে স্মৃতিচারণ

0
272

সৈয়দ রনো : আমি তখন ম্যাজিক লন্ঠন এর সম্পাদক। সাপ্তাহিক আড্ডায় ছড়াকার আবু সালেহকে আড্ডার মধ্যমণি হবার জন্য আমি প্রস্তাব করি। ম্যাজিক লন্ঠনের প্রধান সম্পাদক কবি ও প্রাবন্ধিক রতন মাহমুদ আমার প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করেন। যথারীতি ছড়াকার আবু সালেহ কবি অসীম সাহাকে নিয়ে আড্ডায় উপস্থিত হন। বেশ কিছু ছড়া পাঠ করেন। কবি অসীম সাহা বীর মুক্তিযোদ্ধা ছড়াকার আবু সালেহকে নিয়ে চমৎকার আবেগঘন বক্তৃতা করেন, যা আজকে ভিষণ মনে পড়ছে। কবি অসীম সাহার অকাল প্রয়াণে বাংলা সাহিত্যাঙ্গন কেমন যেনো খা খা মরুভূমির শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে।

কবি অসীম সাহা ডান বাম ঘরানা চিন্তা না করে মুক্ত চিন্তার একজন কবি ছিলেন। তাঁর দেশপ্রেম ছিল কল্পনাতীত। তিনি পশ্চিম বঙ্গের কবিদের প্রাধান্য কম দিয়ে বাংলাদেশী কবিদের মুল্যায়নের জন্য বহু বক্তৃতা করেছেন।
আমি তখন অনুশীলনের সভাপতি। পাবলিক লাইব্রেরির শওকত উসমান স্মৃতি হলে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। অনুষ্ঠানের সভাপতি ছিলেন কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ এবং প্রধান আলোচক ছিলেন কবি অসীম সাহা। দুজনের মধ্যে যে প্রগাঢ় ভালোবাসা তা লক্ষ্য়ণীয় বিষয় ছিল। বলে রাখা ভালো অনুষ্ঠানটির সঞ্চালনার দায়িত্বে আমি ছিলাম।
অনেকেই কবি অসীম সাহাকে মাত্রাতিরিক্ত রাজনৈতিক মতাদর্শের কবি মনে করলেও আমি তাঁকে প্রগতিশীল চিন্তার মানুষ বলে মনে করি। তিনি জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্রের পরিচালক নিযুক্ত হলেও বেশিদিন চাকরিটি টিকিয়ে রাখতে পারেননি। তার মানে তিনি কবি হিসেবে তেলবাজি করতে পারতেন না বলেই আমি জানি। অন্ধের মতো রাজনৈতিক লেজুড়বৃত্তিও করতে না বলেই অর্থ কষ্ট তাঁর পিছু ছাড়েনি।
প্রথম প্রথম প্রতিক্রিয়াশীল লেখক আমিও মনে করতাম, মনে করতাম ভুল ধরাই তাঁর কাজ। না এ কথাটি সঠিক নয়, যতই তাঁর ঘনিষ্ঠ হয়েছি, ততই দেখেছি তিনি শুদ্ধতম মানুষ ছিলেন। ছিলেন সত্য উচ্চারণের এক বলিষ্ঠতম মহান পুরুষ। তিনি সমালোচক ছিলেন বটে, তবে তিনি নিজেরও সমালোচনা করেছেন নিঃসংকোচে। কবি ও গীতিকার অঞ্জনা সাহা কবি অসীম সাহার স্ত্রীকে নিয়ে অন্যধারার একটি অনুষ্ঠানে সংস্কৃতি বিকাশ কেন্দ্রে এলেন। বক্তৃতা করতে গিয়ে কবি বললেন, আমি এবং আমার স্ত্রী হার্টের রোগী, আমাদের প্রতিদিন ৫০০ টাকার ঔষধ লাগে, টাকার অভাবে প্রতিদিন ঔষধ খেতে পারি না। আমি সেদিন খুব কষ্ট পেয়েছিলাম। ভাবছিলাম এতো জানা শোনা প্রজ্ঞাবান মানুষ, রাষ্ট্র তাঁর দায়িত্ব নিতে পারে না। যে দেশে রাতারাতি আঙুল ফুলে কলাগাছ বনে য়ায় একজন লেখাপড়া না জানা ব্যক্তি, সেখানে কবি অসীম সাহা ঔষধ খেতে পারে না। হায়রে স্বাধীন সোনার বাংলাদেশ।
কবি শাওনসহ কয়েকজন মিলে কাব্যশীলন নামক একটি ম্যগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করলো। আমার অফিসে এসে শাওন বললো কবি অসীম সাহাকে প্রধান সম্পাদক করে আমরা একটি ম্যগাজিন প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করেছি, এখন আপনাকে লেখা দিতে হবে। আমি বললাম ঠিক আছে তোমার ইনবক্সে আমি লেখা দিয়ে দিলাম। তাড়াতাড়ির মধ্যে চোখের সামনে যে কবিতা ছিল দিয়ে দিলাম। দুইদিন পর রাতে শাওন পান চিবাতে চিবাতে ফোনে আমাকে বললো রনো ভাই সিলেকশন বোর্ডে আপনার লেখাটির প্রশংসা করেছে কবি অসীম সাহা। আমি বললাম ধুরো মিয়া আমি তোমাদের জন্য একটি শক্তিশালী কবিতা লিখেছি সেটা দিয়ে দাও। সে বললো না রনো ভাই কবি অসীম সাহা ধমক দিবে। কবিতাটি আমাকে দিয়ে রাখুন আগামী সংখ্যার জন্য নির্বাচনী বোর্ডে উপস্থাপন করবো। আমি বললাম কবি অসীম দাদার দিকে খেয়াল রেখো। ও বললো আমরা নিয়মিত দাদার কাঁটাবন অফিসে যাওয়ার সুবাধে দাদার খোঁজ খবর রাখতে পারছি।
কবি আল মাহমুদ অন্যধারার অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি। কবি অসীম সাহা অনুষ্ঠানের বিশেষ অতিথি। অনুষ্ঠানের সভাপতি প্রাকৃতজ শামিম রুমি টিটন। বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবিরাও সেখানে আমন্ত্রিত অতিথি। অনুষ্ঠানের আগের রাতে শুরু হলো হৈচৈ। অতিথিদের মধ্যে এ আসবে ও আসবে না। আমি কবি অসীম সাহাকে ফোন দিলাম দাদা বললো কে থাকবে আর কে থাকবে না সেটা আমার বিষয় নয় আমি থাকবো। তবে দুই একজন অতিথি না থাকার জন্য অজুহাত দেখালেন। প্রাকৃতজ শামিম রুমি টিটনের বাসায় আমি। এ গল্প ও গল্প করতে করতে রাত্রি তখন প্রায় দেড়টা হবে। প্রাকৃতজ শামিম রুমি টিটন সব অতিথিদের ফোন দিতে শুরু করলেন। কবি অসীম সাহাকেও ফোন দিলেন তিনি ফোন ধরে কুশলাদি বিনিময়ের পরে সাফ জানিয়ে দিলেন আমি অনুষ্ঠানে আসছি চিন্তা করো না। রাজনৈতিক বিভাজনে কবিরা যখন বিভক্ত তখন কবি অসীম সাহা বলতেন কবিদের আদর্শ থাকবে কিন্তু বিভেদ থাকতে নেই।
কবি অসীম সাহা তখন আমাদের সংগঠনের উপদেষ্টা। সংগঠনের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী পশ্চিমবঙ্গের কবিদের সংবর্ধনা দেওয়ার জন্য দিন রাত কাজ করছি । কচিকাঁচা মিলনায়তন, সেগুনবাগিচায় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। স্মারকপত্রে স্বাক্ষর করবেন উপদেষ্টাদের মধ্যে কবি আল মুজাহিদী, কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা, কবি অসীম সাহা, অধ্যাপক নিরঞ্জন অধিকারী, কবি জাহাঙ্গীর ফিরোজ, কবি রেজাউদ্দিন স্টালিন ও কবি আসলাম সানী। আমার স্বাক্ষরও ছিল। কবি মরহুম মালেক জোমাদ্দার দুইশত উত্তরীয় পাঠিয়েছেন। স্মারকপত্রে কবি অসীম সাহার স্বাক্ষর আনতে কাঁটাবন গেলাম, তিনি বানান ভুল ধরলেন। ২০০ পিচ স্মারকপত্র আবার প্রিন্ট করে নিয়ে গেলাম কবি অসীম সাহাসহ সবাই স্বাক্ষর করে দিলেন।
কবি অসীম সাহার একটি বক্তব্য জীবনে কোন দিন ভুলবো না। তিনি বলতেন বাংলা অভিধান শিয়রের কাছে রাখবে। পারলে প্রতিমাসে একবার করে খতম দিবে, তাহলে তোমার কবি জীবন সার্থক হবে। কবি অসীম সাহা জীবন্ত বাংলা অভিধান ছিলেন। অভিধানের মুদ্রণ বিভ্রান্তি নিয়ে সাহস করে একমাত্র কবি অসীম সাহাকেই আলোচনা করতে শুনেছি। তিনি ছিলেন সত্য উচ্চারণে সাহসের প্রতীক।
– চলবে

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here