লোকসঙ্গীত যেন জীবনের চালচিত্র

0
986

 

মধুবন চক্রবর্তি:

চেতনার জাগরণে
সেই মাটির গানে

শিক্ষা সভ্যতা বিস্তারের অনেক আগে থেকেই সংগীতের সঙ্গে মানব জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। আসলে প্রকৃতি থেকেই উদ্ভূত সুর আমাদের হৃদয়কে ধীরে আলোড়িত করেছে। প্রকৃতি আর সুর একে অন্যের পরিপূরক। প্রকৃতির মধ্যে যে অপার সৌন্দর্য তার মধ্যে প্রতিটি ঋতুর মাধুর্যের অন্তস্থলেই সুরের বসবাস, যা চেতনার অবচেতনে উপলব্ধিতে, ভালবাসার রাজপ্রাসাদ গড়ে দিয়েছে। নদীর কুলুকুলু ধ্বনিতে, বাতাসের আন্দোলিত পাতার মর্মরে, পাখির কলতানে, প্রকৃতির অন্তরে অন্দরে এই সুর খেলা করে। এই সুর কখনো লোকসুর হয়ে, নাগরিক জীবনের বাহুল্য থেকে অনেক দূরে সবরকম জটিলতা মুক্ত এক উন্মুক্ত পরিবেশ নির্মাণ করে, যা মাটির খুব কাছাকাছি। ছোটনাগপুরে মালভূমির বুকে পূর্ব জেলার চাকুলিয়ার কাছে সুবর্ণরেখা। আর তার শাখানদী সুন্দরী ডুলুং। এই নদীর স্রোতধ্বনি আপনাকে এক স্বর্গীয় সুরের কাছে নিয়ে যাবে। হারিয়ে যাবেন আপনি এক অনাবিল আশ্চর্য জগতে লোকসংগীত বা দেশি সংগীত মানব সমাজের আত্মার আত্মীয়। আনন্দ বেদনা সুখ-দুঃখ বিরহের নিত্যসঙ্গী। যে সংগীতে দরবারি আভিজাত্য যেরকম নেই, তেমনি নেই নাগরিক সভ্যতার যান্ত্রিক আড়ম্বর। এর মূলধন হল উন্মুক্ত আকাশ, একঝাঁক সবুজ সতেজ প্রাণ, সরল সাদাসিধের মানুষের জীবন যাপন, তাদের কথা বলা। উদার সারল্যের সাতকাহন। নদী, নৌকো বাংলার প্রকৃতি এসব কিছুর মধ্যেও অঞ্চলভেদে সুর কখনো বিবর্তিত হয়ে নাগরিক জীবনের সাথেও মিশেছে বাংলার সংস্কৃতি ঐতিহ্য খাদ্যাভ্যাস, উৎসব, মেলা আনন্দ অনুষ্ঠান সবকিছুই জুড়ে গেছে এই লোকসুরের সঙ্গে। আবার আধুনিক বা নাগরিক সুরের সঙ্গে লোকসুরের মিশ্রণে কখনও তৈরি হয়েছে অসাধারণ ছন্দ লহরী। গিয়াসউদ্দিনের সঙ্গীত আয়োজনে কি চমৎকার সর্ষে ইলিশ থেকে লাউয়ের বর্ণনা উঠে এসেছে বিভিন্ন গানে। যা নির্মিত হয়েছে লোক গানের আধারে। লোকসংগীতকে বা পল্লী কবিতাকে যুগে যুগে সমৃদ্ধ করেছেন বহু পদকর্তা। লোককবি বা পল্লী কবি যারা গানের ছক বাধা নিয়মকে অনেক ক্ষেত্রে যেমন অনুসরণ করেছেন আবার প্রথা ভেঙে বিভিন্ন গান রচনা করেছেন। মরমী গানের সব ধারাকে নিখুঁতভাবে অনুসরণ করেছিলেন হাসন রাজা। ঈশ্বরানুভক্তি এবং জগৎজীবনের অনিত্যতা ও প্রমোদমত্ত মানুষ সাধনভজনে যে ক্রমশ অক্ষমতার পরিচয় দিচ্ছে, সে বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করে অসংখ্য গান রচনা করেছেন তিনি। অদৃশ্য নিয়ন্ত্রকের হাতেই যে ঘুড়ি, সে কথা যেমন বলেছেন, তেমনি সম্প্রদায়ের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে মানবিক ধর্মের এক লোকায়ত ঐক্যের সুর রচনা করেছেন হাসন রাজা। তাঁর পদগুলি পড়লেই বোঝা যায় তিনি সম্প্রীতির কথা বলেছেন। হাসন রাজার জীবনদর্শন সম্পর্কে রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন, “পূর্ব বাংলার এই গ্রাম্যকবির মাঝে এমন এক গভীরতত্ত্ব খুঁজে পাই ব্যক্তি স্বরূপের সঙ্গে সম্বন্ধ সূত্রে যা বিশ্ব সত্য”..অন্যদিকে লালন সাঁই বিশ্বাস করতেন সকল মানুষের মাঝে বাস করে মনের মানুষ। আত্মসাধনার মাধ্যমে সেই অধরা ধরা দেয় হৃদকমলে। মনের মানুষের কোন ধর্ম, জাত বর্ণ, লিঙ্গ, কুল বলে কিছু নেই। মানুষের দৃশ্যমান শরীর, এবং অদৃশ্য মনের মানুষ পরস্পর বিচ্ছিন্ন। যদিও শরীরে-ই মনের বাস। তাকে বিবেচনা করেছেন লালন সাই অজানা অস্পৃশ্য এক সত্ত্বা রূপে যা রহস্যময়। লালন সাঁই বলছেন-
“খাঁচার ভিতর অচিন পাখি
কেমনে আসে যায়
তারে ধরতে পারলে মন বেড়ি
দিতাম পাখির পায়ে’….
খাঁচার ভিতর অচিন পাখি গানে মনের অভ্যন্তর সত্তাকে বা অন্তরের আত্মাকে এমন এক পরিসরের সঙ্গে তুলনা করেছেন যা সহজেই খাঁচা নামক দেহের মাঝে আসা-যাওয়া করে। তবে কিছুতেই তাকে বন্দি করা যায় না। তার এই ধর্মবিশ্বাস নিয়ে উপন্যাসিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় একসময় বলেছিলেন মানবিক ধর্মের বন্ধনকে আরও দৃঢ় করা। সকল সম্প্রদায়ের ঐতিহ্যকে আপন করে ধর্মের সীমাবদ্ধতাকে অতিক্রম করে সর্ব মানবিক ধর্মীয় চেতনাকে এক লোকায়ত ঐক্যসুত্র রচনা করাই ছিল হাসন রাজার জীবনদর্শন। হাসন রাজার গান এবং লালন শাহের রচনা মাটির জ্ঞানকে লোকসংগীতকে লোকসংগীত এর আধ্যাত্মিক জগতকে যেভাবে সমৃদ্ধ করেছে সর্ব ধর্মের সম্প্রীতির কথা বলেছে লোকসংগীত এর আরো বিভিন্ন ধারা অথবা বিভিন্ন পদকর্তার রচনার মধ্য দিয়ে উঠে এসেছে সেই সব লোকসঙ্গীত। লোকসংগীত এর আরেকটি বিশেষ সংগ্রহ হল ঝুমুর। সবথেকে আকর্ষণীয় একটি ধারার নাম ঝুমুর। যার অকৃত্রিম সুর, মাদলের বোল রসবৈচিত্র্য, সুরের মূর্ছনা এক অপূর্ব মাতন সৃষ্টি করে মানুষের হৃদয়। পুরুলিয়া বাঁকুড়া পশ্চিম মেদিনীপুর বিহার ওড়িশা এবং অসমের কিছু অংশ জুড়েই ঝুমুর বলায় তৈরি হয়েছে। ঝুমুর মূলত লোকগানের একটি বিশেষ অঙ্গ। যা প্রেম সঙ্গীত রূপেই গণ্য করা হয়। মাটির খুব কাছাকাছি এই গান মাদল ধামসা, বাঁশি, ঘুঙুর, খোল, চেরাপাটি সহযোগে গাওয়ার রীতি। লালমাটি, পাথর, ঢেউ-খেলানো জমি, বনাঞ্চল, শাল, কুসুম, শিমুল, মহুয়া, ঝিঙে ফুল আর পলাশের পরাগজুড়ে এই গান প্রাকৃতিক পরিবেশের সঙ্গে মিলেমিশে যেন একাকার হয়ে থাকে। লোকগানে বারে বারে ঘুরে ফিরে আসে ঝুমুর শব্দ ঝুমুর শব্দের মধ্যে মন মাতাল করা গন্ধ বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন গীতিকাররা ঝুমুর অঙ্গকে ব্যবহার করেছেন গান রচনার ক্ষেত্রে ঝুমুর মিশ্রণ ঘটিয়ে এক সুন্দর রচনা করেছেন। সাহিত্যের হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই গান প্রায় হাজার বছরের প্রাচীন। তাঁর মতে ঝুমুরের সঙ্গে কীর্তন মিশে পরবর্তীকালে যাত্রাপালার উদ্ভব হয়। আবার “সংগীত দামোদরে”র উক্তি ঝুমুর গান শৃঙ্গার রসের এবং তাতে মধুর ব্যঞ্জন আছে। ঝুমুর প্রাচীন ধারার লোকসংগীত। আদিতে আদিবাসি বিশেষ করে সাঁওতালদের গান ছিল। এখনও যা জনপ্রিয়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম এইসব গান জনপ্রিয় থাকবে ঝুমুর চিরায়ত লোকসংগীতের সুর। বাংলাদেশের রাজশাহী ফরিদপুর জেলাতেও এই গানের প্রচলন আছে। লৌকিক ঝুমুর গানের বিষয়বস্তু হল রাধাকৃষ্ণের পার্থিব প্রেম। আবার উক্তি প্রত্যুক্তিমূলক ঝুমুর গানের মধ্যে রয়েছে নাটকীয়তা। বৈঠকই বা ছুট ঝুমুর গান লোকনাট্য বলেই বিবেচিত হতো ঝুমুরের অনেক ধারা, অনেক বৈশিষ্ট্য। সাহিত্যরত্ন হরেকৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়ের মতে, এই ঝুমুর প্রায় হাজার বছর ধরে প্রবাহিত হয়ে আসছে ঝুমুরের সঙ্গে মিশেছে কীর্তন পরবর্তীকালে যা যাত্রার উদ্ভব ঘটিয়েছে। একটা সময় ছিল যখন মৃত্যু গীত সহযোগে এই ঝুমুর গান গাওয়া হতো। গোবিন্দ দাসের পদেও পাওয়া যায় “”মদনমোহন হরি মাতলো মনসিজ যুবতী গাওতো ঝুমরি””. নৃত্য গীত ও বাধ্য সহযোগে ঝুমুর গাওয়া হলেও এর মধ্যে গীতের প্রাধান্য থাকে বেশি সুর উচ্চ গ্রাম থেকে নিম্ন গ্রামে অবরোহন করা হয় যা ঝুমুরের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। সবুজ নারীর যে আসর হতো সেখানে বৈঠকি ছুট ও পালাবদ্ধ ঝুমুর গাওয়া হত সমঝদারের আসরে বৈঠকে ছুট ও পালাবদ্ধ ঝুমুর গাওয়া হত। বৈঠকি ঝুমুরে গায়ক একজনই থাকতো সেখানে কোন নৃত্য প্রদর্শন হত না তবে বাধ্য হিসেবে রাখা হতো হারমোনিয়াম পাখোয়াজ। আবার ছুট ঝুমুর হলো পূর্ণাঙ্গ ঝুমুর পালা ঝুমুর গাওয়া হতো একটি বিষয়কে কেন্দ্র করে ঝুমুরকে কেন্দ্র করে বেশ কিছু সুর ও তালের প্রচলন হয়েছিল যা এখন অধিকাংশই অবলুপ্ত। ঝুমুরের আকর্ষণীয় দিক হলো এর অকৃত্রিম সুর এবং তার সঙ্গে মাদলের বোল। বাদ্যযন্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয় মাদল, ধামসা, বাঁশি, ঘুঙুর, খোল, চেরাপেটি। হিসেবের বাইরে একটা আনন্দ থাকে। মানুষ দেখার আনন্দ, মানুষ বোঝার আনন্দ। মানুষের মেলায় ঘুরতে ঘুরতে মানুষকে ভালবাসার আনন্দ। সব জাত সব বর্ণের মধ্যে সেই মানুষকে, আসল মানুষকে খুঁজে নিতে হয়। ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতে একটি বিশেষ অঙ্গ হলো লোকসংগীত। লোকসংগীত এর মধ্যে দিয়ে হৃদয়ের অন্তঃস্থলে যেরকম পৌঁছানো যায় সেভাবেই মনের মানুষের সন্ধানে পাওয়া যায় অনায়াসে। ঝুমুর হল সেই আনন্দ লোকসংগীতের মধ্যে আরও একটি বিশেষ দিক হল বিয়ের গান, ‘যা আজ অনেকটাই ফিকে হতে বসেছে। এখনকার বিয়েবাড়িতে বিয়ের গান বলতে ডিজের দাপট। কিংবা কোন পাঞ্জাবি ভাংরা। অথবা সমসাময়িক কোনো সিনেমা বা মিউজিক ভিডিও গান যা বাজার চলতি বা জনপ্রিয়। কিন্তু একসময় বিয়ের গানের প্রচলন ছিল বহুল। যে গানগুলি অবিভক্ত বাংলার বিভিন্ন জেলায় জেলায় গাওয়া হতো। ফলে এতে আঞ্চলিক ভাষার মাধুর্য এবং প্রাচুর্য মানুষকে নাড়া দিয়ে যেত। প্রথা অনুযায়ী বিভিন্ন স্তরভেদে আঞ্চলিক ভাষায় বিয়ের গানগুলি প্রবাহমাণ কাল ধরে বয়ে আসছে। প্রচলিত লোকসংগীতের একটি বিশেষ ধারা হচ্ছে এই বিয়ের গান। যা বিনোদনের বিশেষ অঙ্গ ছিল একসময়ে। গানের গঠন একেবারে ভিন্ন ভিন্ন ভাবে উপস্থাপন হতো। কোথাও গানের তিন অন্তরা। কোথাও বা বেশি। বিনোদনের অঙ্গ হিসেবে মুখ্য আকর্ষণীয় বিষয় ছিল এই ধারার লোকসংগীত যা একসময় জনপ্রিয় করে তুলেছিলেন প্রখ্যাত লোকসংগীত শিল্পী নির্মলেন্দু চৌধুরী। সংগীত সাধনায় অনন্য অবদানের জন্য ভারত সরকার যাকে পদ্মপভূষণে বিভুষিত করেছিলেন। তাঁর কন্ঠে গাওয়া ‘সোহাগ চাঁদ বদনী ধ্বনি’ নাচত দেখি’. এই গান আজও বাংলার সম্পদ। এবারে আসি লোকসংগীতের আরও একটি বৈশিষ্ট্যে। তা হল ভাওয়াইয়া। ভাওয়াইয়া মূলত বাংলাদেশের রংপুর ও ভারতের পশ্চিমবঙ্গের কোচবিহার এবং অসমের গোয়ালপাড়ায় প্রচলিত একপ্রকার পল্লীগীতি। লোকায়ত সংস্কৃতি, মানুষের জীবন যাপনের কথা বা জনপদের জীবনযাত্রা, তাদের কর্মক্ষেত্র, পারিবারিক ঘটনা ও তার সার্থক প্রয়োগ দেখা যায় এই বিশেষ ধরনের পল্লীগীতিতে। ভাও+ইয়া অর্থাৎ যে সমস্ত গানের মধ্যে দিয়ে মনের অনুভূতি প্রকাশ করা যায় সেই জ্ঞানই হলো ভাওয়াইয়া গান এই গানের উৎসভূমি রংপুর। বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলে নদী-নালা তুলনামূলক ভাবে কম থাকায় গরুর গাড়িতে চলাচলের প্রচলন বেশি ছিল আর গরুর গাড়ির চাকা পরলে তার গানের সুরে আধো ভাঙা বা ভাঁজ পড়ে এরকম সুরে ভাঙা ভাঁজ পরা গীতররীতি গানের গঠনের মধ্যে ঢুকে যায়। এইরকম সুর ভাঙা বা ভাঁজ পরা গীতরীতে ভাওয়াইয়া গানের বৈশিষ্ট্য মাটির টানে চাষে গেয়ে ওঠে ভাওয়াইয়া। পিঠেপুলী উৎসবেও এই গানের প্রভূত প্রভাব রয়েছে। যেমন- “মনটা মোর পিঠা খাবার চাই কিংবা “ও কি গাড়িয়াল ভাই কত রব আমি পন্থের দিকে চাঞা রে যেদিন গাড়িয়াল উজান যায়”..
মাটির টানে বানভাসি এই লোকসঙ্গীত জীবনের সব রং রূপ ধরে রেখেছে আজীবন। বিয়ের গান যা বাংলার ঐতিহ্য বাংলার উল্লেখযোগ্য সম্পদ। সেই ঐতিহ্য বা ধারাবাহিকতা আজ আর বহন করা হয় না ঠিকই, নাগরিক সভ্যতার উত্থানের পরপর এই লোকসংগীত অনেকটাই তার ঐতিহ্য হারিয়েছে। তবু এই বিয়ের গানের মধ্যেই বেঁচে আছে বাংলার সংস্কৃতি, মাটির টান, সম্প্রীতির গন্ধ। এক অনাবিল আনন্দের ধারা যেখানে বয়ে চলে। রয়েছে মানুষ দেখার আনন্দ। দুটি মানুষের মনের মিলনের মাঝেও বহু মানুষ মিলিত হয় তাদের শুভেচ্ছা জানাতে, তাদের কেন্দ্র করে গড়ে ওঠে এক আনন্দের ভুবন এক মেলা। মানুষের মেলা। এই গানের মধ্যে দিয়ে তৈরি হয় সম্প্রীতি উৎসব। ধামাইল হল আর এক ধরনের বিয়ের গান। শুধু গান নয় ধামালি মৃত্যু অত্যন্ত জনপ্রিয় আর আনন্দের কথা যদি বলা যায় তাহলে ধামাইল গানের মত আনন্দের মরছো না হয়তো খুব কম গানই নির্মাণ করতে পারে। ধামা শব্দ থেকে ধামাইল শব্দের উৎপত্তি। এর আঞ্চলিক অর্থ উঠোনও বলা যেতে পারে। বাড়ির উঠোন বা দালানে নৃত্য গীতের মাধ্যমে এই ধামাইল পরিবেশিত হত বলে একে ধামাইল গান বলা হত। যেকোনো মাঙ্গলিক অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় আচারে এই গান পরিবেশিত হয়। মূলত কাহিনীমূলক পরিবেশনা। একটি বিশেষ গল্প বা কাহিনী এবং বিষয়কে কেন্দ্র করে গড়ে উঠে এই ধামাইল গান যা সিলেট অঞ্চলের লোকসাহিত্যের একটি অংশ বটে। বাড়ির খোলা প্রাঙ্গণে কুড়ি পঁচিশ জন নারী গোল হয়ে দাঁড়িয়ে নৃত্যনুষ্ঠান প্রদর্শন করেন এই ধামাইল গানে ভাটিয়ালি অন্তর্গত ধামাইল তবে দীর্ঘ টান এই সুরে নেই কিংবা মীড়ের আধিক্যও নেই। স্বতন্ত্র বাদ্যযন্ত্র প্রয়োজন হয় না। ছন্দ ধরে রাখা হয় হাতে তালি বাজিয়ে অর্থাৎ করতালি দিয়ে গানের তাল রক্ষা করা হয় আর সেই সুমিষ্ট ছন্দে মনের আনন্দে গান গেয়ে থাকেন তারা। তবে কৃষ্ণ ধামাইল শুনলে সেই আনন্দ দ্বিগুণ বেড়ে যাবে কারণ এ আনন্দের অন্তরে বাস করে সদানন্দময় প্রেম। রাধাকৃষ্ণ বিষয়ক কথোপকথন মূলক লোকগীতিকেই কৃষ্ণধামাইল বলা হয়, রাধা কৃষ্ণের প্রেম যেরকম এই ধামাইলে পাওয়া যায়। পাশাপাশি পার্থিব বিষয় উঠে আসে এই গানে। বড়ু চন্ডীদাসের শ্রীকৃষ্ণকীর্তন গড়ে উঠেছে লোকও প্রচলিত ধামালি ও ঝুমুর গানের আঙ্গিক থেকে। আমরা ফিরে আসি বারবার এই মাটির কাছাকাছি। যত দূরেই যাই না কেন, মাটি আমাদের টানে, আমাদের দেশ, আমাদের গ্রাম, আমাদের ভালবাসার শহর, আমাদের আপনজন সবার কাছেই তো একদিন ফিরে আসতেই হয়। লোকসংগীত আমাদের বাংলার সম্পদ। ভালোবাসার আকর। মাটির গন্ধ। মাটির টানে তাই বানভাসি হতেই হয় আমাদের।

লেখক: প্রাবন্ধিক

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here