আজ সোমবার, ২০ শ্রাবণ ১৪৩২ বঙ্গাব্দ ।   ৪ আগস্ট ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ

অবরোধ, শ্রমিক অস্থিরতা/ প্রভাব পড়ছে নিত্যপণ্যের দামে

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

আলোকিত ডেস্ক:

আগামী জানুয়ারিতে অনুষ্ঠেয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ক্রমবর্ধমানভাবে অস্থিতিশীল হয়ে উঠছে। ইতোমধ্যে বিরোধী দলগুলো হরতাল ও অবরোধ কর্মসূচি দিয়েছে। এর সঙ্গে যোগ হয়েছে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভ। যার প্রভাব পড়ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ ব্যবস্থায়। ফলে, পরিবহন ব্যয় আগের চেয়ে বেড়েছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। জানা গেছে, পরিবহন ব্যয় বৃদ্ধির কারণে নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দামও বেড়েছে। এমনিতেই দেশে গত ১৮ মাস ধরে মূল্যস্ফীতির সঙ্গে লড়াই করছে সাধারণ মানুষ। নতুন করে আবার নিত্যপণ্যের দাম বাড়ায় তাদের দুর্ভোগ আরও বেড়েছে। বিরোধী দলগুলোর ডাকা অবরোধ কর্মসূচিতে সহিংসতার আশঙ্কায় অধিকাংশ যানবাহন রাস্তায় চলাচল করেনি। এই সুযোগে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান ও লরি মালিকরা ভাড়া ২০ থেকে ৪০ শতাংশ বাড়িয়েছেন। ফলে পণ্য পরিবহনে বাড়তি টাকা ব্যয় করতে হচ্ছে বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। পণ্য আমদানিকারক ও প্রসেসরের করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অ্যাফেয়ার্স বিভাগের পরিচালক বিশ্বজিৎ সাহা বলেন, ‘সিটি গ্রুপ স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় ৭০ শতাংশ পণ্য বাজারে সরবরাহ করতে পেরেছে। তিনি আরও বলেন, সিটি গ্রুপ সাধারণত নিজস্ব পরিবহনের পাশাপাশি ভাড়া করা যানবাহনে দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য সরবরাহ করে। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে, ভাড়া করা যানবাহন পাওয়া যায়নি। দেশের অন্যতম বৃহৎ ভোজ্যতেল উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান টিকে গ্রুপের ফাইন্যান্স অ্যান্ড অপারেশনস বিভাগের পরিচালক শফিউল আথের তসলিম বলেন, অবরোধের আগে সকাল ৬টায় পণ্যবাহী গাড়িগুলো ঢাকার গুদাম থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্দেশে ছেড়ে যেত। কিন্তু এখন বিকেল ৩টা বা ৪টায় রওনা হয়। তারপর সেগুলো মধ্যরাতে গন্তব্যে পৌঁছায়, এটি এমন একটি সময় যখন সেখানে শ্রমিক পাওয়া যায় না। ফলে পরদিন সকালে যানবাহনগুলো ঢাকায় ফিরতে পারছে না। অথচ অবরোধের আগে একদিনে দুটি ট্রিপ শেষ করতে পারলেও এখন একটির বেশি ট্রিপ শেষ করতে পারছে না, বলেন তিনি। তিনি আরও বলেন, এতে আমাদের পরিবহন ও শ্রমিক খরচ বেড়েছে। সব মিলিয়ে আমরা খারাপ অবস্থায় আছি। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজের একজন নির্বাহীও একই কথা বলেন। তিনি বলেন, সরবরাহ ব্যবস্থা বিঘ্নিত হওয়ায় আমরা চাহিদার সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে পণ্যের স্বাভাবিক সরবরাহ নিশ্চিত করতে পারছি না। রাজধানীর শ্যামবাজারের পেঁয়াজের পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ হাফিজ উদ্দিন বলেন, অবরোধের আগে চট্টগ্রাম থেকে পেঁয়াজ ভর্তি একটি ট্রাক রাজধানীতে আনতে ২৫ হাজার টাকা খরচ হতো। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। কারওয়ান বাজারের সবজির পাইকারি বিক্রেতা মোহাম্মদ আমিরুল ইসলাম জানান, ঠাকুরগাঁও থেকে লাউ ও শসাসহ এক ট্রাক সবজি ঢাকায় আনার খরচ ২৩ হাজার টাকা থেকে বেড়ে ৩২ হাজার হয়েছে। চট্টগ্রামের ক্লিয়ারিং অ্যান্ড ফরওয়ার্ডিং এজেন্ট আলী হোসেন বলেন, ট্রাক ও কাভার্ডভ্যানের ভাড়া দুই থেকে ছয় হাজার টাকা বেড়েছে। যেমন- চট্টগ্রাম বন্দর থেকে গাজীপুরে পণ্য পাঠাতে ব্যবহৃত কাভার্ডভ্যানের ভাড়া বেড়ে হয়েছে ২১ হাজার টাকা। এক সপ্তাহ আগে যা ছিল ১৫ হাজার টাকা। ট্রাক ও কাভার্ডভ্যান মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক চৌধুরী জাফর আহমেদ বলেন, অবরোধের সময় বন্দর থেকে আমদানি পণ্য খালাস হলেও রফতানি পণ্য পাঠানো হচ্ছে না। তিনি বলেন, ফলে আমদানি পণ্য ডেলিভারি দিয়ে খালি ফিরছে পরিবহন। বাংলাদেশ টেরি টাওয়েল অ্যান্ড লিনেন ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান এম শাহাদাত হোসেন বলেন, পোশাক খাতের চলমান পরিস্থিতি নিয়ে শ্রমিকরা সচেতন। এছাড়া তারা প্রতি বছর কমপক্ষে ৫ শতাংশ ইনক্রিমেন্ট পান। আমি জানি না তারপরও কেন সারা দেশে শ্রমিক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়েছে, বলেন তিনি। পোশাক খাতের শ্রমিকদের জন্য নতুন ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণের জন্য মালিক, শ্রমিক, সরকার ও স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত একটি ন্যূনতম মজুরি বোর্ড কাজ করছে। প্যাসিফিক জিন্স লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ এম তানভীর বলেন, ‘আগামী ১ ডিসেম্বর থেকে নতুন মজুরি কার্যকর করতে মালিকরা সম্মত হয়েছেন। তাই এ অস্থিরতা গ্রহণযোগ্য নয়। তিনি আরও বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা বৃদ্ধি নিয়ে ব্যবসায়ীরা উদ্বিগ্ন, কারণ তারা লিড টাইম নিয়ে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়ছেন। প্রিমিয়ার সিমেন্ট মিলস লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ আমিরুল হক বলেন, রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার মধ্যে ব্যবসা করা সত্যিই কঠিন। স্থিতিশীল রাজনৈতিক পরিস্থিতি ও সুশাসন টেকসই ব্যবসার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। যশোরে পণ্য পরিবহন খরচ বেড়েছে: স্বাভাবিক সময়ে বেনাপোল থেকে ঢাকায় পণ্য পরিবহনে ট্রাক ভাড়া ছিল ১৮ হাজার টাকা। সেখানে এখন নেয়া হচ্ছে ২৫-২৬ হাজার টাকা। এ কারণে আমদানিও কমিয়ে দিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। এখন আমদানি প্রতিদিন হচ্ছে ১৫০-২০০ ট্রাক, যা স্বাভাবিক সময়ে ছিল ৩৫০-৪০০ ট্রাক। তবে বেনাপোল বন্দরের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক (ট্রাফিক) রেজাউল করিম বলেন, ‘অবরোধের মধ্যেও বন্দরে আমদানি-রফতানি কার্যক্রম চলমান। গত দুদিনে ৩৭৫ ট্রাক পণ্য আমদানি হয়েছে। তবে স্বাভাবিক সময়ে আমাদের এখান থেকে প্রতিদিন আমদানি হয় গড়ে ৪০০ ট্রাক। খালাস হয় ৩৫০-৪০০ ট্রাক। সে তুলনায় আমদানি ও খালাস কম হচ্ছে। বেনাপোল শুল্ক ভবনের যুগ্ম কমিশনার মো. শাফায়েত হোসেন বলেন, বেনাপোল কাস্টম হাউজে শুল্কায়নের কাজ যথা নিয়মে চলেছে। আমদানি-রফতানি স্বাভাবিক রয়েছে।’ ট্রাক ভাড়া অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন ব্যবসায়ীরা। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে খালাস করে নিয়ে যাচ্ছেন। ঢাকার আমদানিকারক প্যাকস্টন লিমিটেডের প্রতিনিধি ফারুক আহমেদ বলেন, অবরোধের কারণে বেনাপোল থেকে ঢাকায় আসতে ট্রাক ভাড়া বেড়েছে ৭-৮ হাজার টাকা। এতে আমাদের ব্যয়ও বাড়ছে। নারায়ণগঞ্জের আইডিয়াল ফাইবার লিমিটেডের প্রতিনিধি শাহ আলম বলেন, একে তো দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভালো নেই। তারপর এখন বেড়েছে ট্রাক ভাড়া। ট্রাকপ্রতি বেশি নেয়া হচ্ছে ৭-৮ হাজার টাকা। আবার সরকার রাজস্বও বাড়িয়েছে। এতে ব্যবসায়ীরা সমস্যায় পড়েছেন। ঢাকার নবাবপুরের তালুকদার ট্রেডার্স নামের আমদানিকারক ইকবাল আহমেদ বলেন, ‘আমার ব্যবসার কেমিক্যাল ভারত থেকে আসে। কয়েকটি পণ্যের চালান ৩১ সেপ্টেম্বর বেনাপোল বন্দরে এসেছে। বন্দরের সব আনুষ্ঠানিকতাও শেষ করেছি। গতকাল ট্রাক ভাড়া করতে গেলে ভাড়া এক লাফে ৮ হাজার টাকা বেশি বলছেন চালকরা। অতিরিক্ত ট্রাক ভাড়ার কারণে পণ্য বেনাপোল বন্দর থেকে কারখানায় নিতে পারছি না। তবে বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট এজেন্সি মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক আজিম উদ্দিন গাজী বলেন, ‘অবরোধের কারণে দেশের বিভিন্ন স্থানে গাড়ি ভাঙচুর করা হচ্ছে। এতে মালিকরা ট্রাক রাস্তায় নামাতে চাইছেন না। আবার চালকরাও গাড়ি চালাতে অসম্মতি জানাচ্ছেন। বেনাপোল বন্দর থেকে সারা দেশে পণ্য পরিবহনের ভাড়াও বেড়েছে। বেনাপোল ট্রান্সপোর্ট মালিক সমিতির সভাপতি আতিকুজ্জামান সনি বলেন, আগে বেনাপোল থেকে ঢাকার বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহনে প্রতি ট্রাকের ভাড়া ছিল সর্বনিম্ন ১৭-১৮ হাজার টাকা। একই ট্রাকের ভাড়া এখন বেড়ে হয়েছে ২৫-২৬ হাজার টাকা। একইভাবে কাভার্ড ভ্যানের ভাড়া ২৫ হাজার থেকে বেড়ে হয়েছে ৩৫ হাজার টাকা। এত বেশি ভাড়া দেয়া সত্ত্বেও খালি ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান পাওয়া যাচ্ছে না। বেনাপোল আমদানি-রফতানিকারক সমিতির সহসভাপতি আমিনুল হক বলেন, ‘পরিবহন সংকটের জন্য ট্রাক ভাড়া এখন স্বাভাবিক সময়ের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ। পচনশীল পণ্য নষ্ট হওয়ার আশঙ্কায় বাধ্য হয়ে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে খালাস করে নিয়ে যাচ্ছেন ব্যবসায়ীরা। এদিকে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে শাকসবজি পরিবহনে সমস্যায় পড়তে হচ্ছে ব্যবসায়ীদের। সপ্তাহখানেক আগেও শাকসবজির বাজার ছিল চড়া। দুই-তিনদিন আগে খানিকটা কমেছিল। তবে হরতাল-অবরোধ কর্মসূচির কারণে পরিবহন খরচ বাড়ায়, বেড়ে গেছে শাকসবজির দাম। যার প্রভাব ক্রেতাদের ওপর পড়ছে বলে মনে করেন সবজি চাষী ও ব্যবসায়ীরা। যশোর সদর উপজেলার মথুরাপুর এলাকার আজগর আলী জানান, এক বিঘা জমিতে মুলা চাষ করেছেন তিনি। সপ্তাহখানেক ধরে বিক্রি করছেন। প্রথম দিকে প্রতি কেজি ৪০-৪৫ টাকা দরে বিক্রি করতে পারলেও বুধবার সর্বোচ্চ ২২ টাকা কেজি দরে বিক্রি করতে হয়েছে। পরিবহন খরচের ভয়ে পাইকারি ব্যবসায়ীরা মুলা নেননি। এতে তাকে ক্ষতির মুখে পড়তে হয়েছে। পাইকারি বিক্রেতা মো. মনির হোসেন বলেন, ‘সবজি ঢাকায় পাঠাতে কোনো সমস্যা নেই। সাধারণত আন্দোলনকারীরা শাকসবজির ট্রাক নিয়ে ঝামেলা করে না। কিন্তু ট্রাকের চালকরা ঝুঁকি নিতে চান না, এজন্য বেশি টাকা ভাড়া দাবি করেন। স্বাভাবিক সময়ে চার টন ও সাত টন সবজি পাঠাতে আমার যথাক্রমে ১৬ ও ২২ হাজার টাকা লাগলেও হরতাল ও অবরোধে একই পরিমাণ সবজি পাঠাতে ২২-৩০ হাজার টাকা পরিবহন খরচ দিতে হয়।

আলোকিত প্রতিদিন / ৪ নভেম্বর ২৩/ এসবি

- Advertisement -
- Advertisement -