আলোকিত ডেস্ক:
প্রশ্ন হলো বৈদেশিক বাণিজ্যের আড়ালে কী হচ্ছে? রফতানি করা পণ্যের বিপরীতে যে পরিমাণ আয় দেশে আসার কথা তা আসছে না। আবার বেশি দেখিয়ে পণ্য আমদানির পর দাম কম দেখিয়ে আমদানি হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ব্যাংকগুলোর এলসি খোলার তথ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমের ড্যাশবোর্ডে এলসি খোলার তথ্যের কোনও মিল নেই। বকেয়া আমদানি বিলের পরিমাণ নিয়েও দেখা দিয়েছে সন্দেহ। বিশ্লেষকরা মনে করেন, ১২ বিলিয়ন বা ১ হাজার ২০০ কোটি ডলার বিল পরিশোধ বাকি আছে।
ব্যাংকার্স সভায় বৈদেশিক বাণিজ্যের গুরুত্বপূর্ণ এই বিষয়ে আলোচনা হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়, বকেয়া ১২ বিলিয়নের তথ্য সঠিক নয়, সঠিক তথ্য হলো, সরকারি-বেসরকারি উভয় খাত মিলিয়ে বকেয়া বিলের পরিমাণ সাড়ে ৩ বিলিয়ন বা সাড়ে তিনশ কোটি ডলার।
১. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসেবেই বকেয়ার তথ্যে বড় ধরণের পার্থক্য
আমদানির বিল সম্পর্কিত বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ভুল তথ্য দিচ্ছে অনেক ব্যাংক। প্রতিটি শাখা থেকে এলসি খোলার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমে তথ্য আপলোড করতে হয়। এই ড্যাশবোর্ডে গত ৩০ জুন পর্যন্ত আমদানি বিলের পরিমাণ দেখাচ্ছে ৪ হাজার ৯ কোটি ডলার।
যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগ থেকে আলাদাভাবে তথ্য সংগ্রহ করে এর পরিমাণ পেয়েছে ২ হাজার ৩৭৩ কোটি ডলার। অর্থাৎ ব্যাংকে সংরক্ষিত তথ্যের সঙ্গে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের আমদানি তথ্যে ১ হাজার ৬৩৬ কোটি ডলারের পার্থক্য দেখা দিয়েছে, টাকার অঙ্কে যা ১ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। ব্যাংকিং সেক্টওে অস্থিতীশীলতার প্রধান কারণ বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের চিঠিতে উল্লেখ করা হয়েছে, বৈদেশিক মুদ্রানীতি বিভাগে ব্যাংকগুলোর পাঠানো তথ্য অনুযায়ী ৩০ জুন পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া বিল ছিল ৫১৬.১৯ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। আবার একইসময়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনলাইন ইমপোর্ট মনিটরিং সিস্টেমের ড্যাশবোর্ডে দেখাচ্ছে ওই সময় পর্যন্ত মেয়াদোত্তীর্ণ বকেয়া বিল ছিল ১৫৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার।
দুটি তথ্যে এত বড় পার্থক্যের কারণ জানতে ব্যাংকগুলোকে চিঠি দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। একই সঙ্গে যথাসময়ে ও সঠিকভাবে রিপোর্ট করতে বলা হয়েছে। এ ছাড়া প্রতিদিন প্রতিটি এলসির তথ্য আলাদাভাবে দেওয়ার পাশাপাশি একটি ব্যাংকের ওই দিনের সব এলসির তথ্য এক সঙ্গে দেওয়ার নির্দেশনা রয়েছে। তবে অনেক ব্যাংক তা মানছে না। যদিও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষ থেকে আগামী ১৫ দিনের মধ্যে এ নির্দেশনা পরিপালন করতে বলা হয়েছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা বলেছেন, এত পার্থক্যের কারণ ব্যাংকগুলোই ভালো বলতে পারবে। ব্যাংকগুলোর শাখা থেকে হয়তো ভুল রিপোর্টিংয়ের কারণে এমন হয়েছে।
২. মাসে ঘাটতি থাকছে ৫০ কোটি ডলার
বকেয়া আমদানির দেনা ও বৈদেশিক ঋণ পরিশোধ মিলে প্রতি মাসে যে ডলারের সংস্থান হওয়া দরকার তা হচ্ছে না। বর্তমানে প্রতি মাসে গড়ে ৭০০ কোটি ডলারের আয় হচ্ছে। এর বিপরীতে তাৎক্ষণিক আমদানির দেনা মেটাতে হচ্ছে ৬৫০ কোটি ডলার। ঋণ পরিশোধে ব্যয় হচ্ছে আরও কমপক্ষে ১০০ কোটি ডলার। এ হিসাবে মাসে ঘাটতি থাকছে ৫০ কোটি ডলার। এছাড়া বিদেশে বিভিন্ন সেবা, রয়্যালটি, মুনাফা প্রত্যাবাসনসহ সব মিলে আরও বাড়তি খরচ হচ্ছে। এতে প্রতি মাসে ডলারের ঘাটতি দেখা দিচ্ছে প্রতিনিয়ত।
৩. জ্বালানি আমদানির পেছনেই যাচ্ছে একটি বড় অংশ
দেশে বিদ্যুৎ উৎপাদনে প্রাথমিক জ্বালানি হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে প্রাকৃতিক গ্যাস, কয়লা ও জ্বালানি তেল ফর্নিস অয়েল। এসব জ্বালানির বেশির ভাগই আমদানিনির্ভর। বর্তমানে বিদ্যুৎ উৎপাদনে যে পরিমাণ জ্বালানি চাহিদার প্রয়োজন রয়েছে, তার বার্ষিক আমদানি ব্যয় প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার।
৪. রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির বকেয়া
ডলার সংকটের কারণে রফতানিমুখী শিল্পের কাঁচামাল আমদানির জন্য ব্যাক টু ব্যাক এলসির দেনা নিয়মিত পরিশোধ করতে পারছে না বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো। ফলে এ খাতে মোটা অঙ্কের দেনা বকেয়া পড়ে গেছে। ডলারের জোগান কম থাকায় দেনা পরিশোধের মেয়াদ দফায় দফায় বাড়ানো হচ্ছে। গত ডিসেম্বর পর্যন্ত এ দেনার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ১১৮ কোটি ডলার। ২০২১ সালের ডিসেম্বর পাসে এ খাতে বকেয়া এলসির পরিমাণ ছিল ১১৩ কোটি ৪৯ লাখ ডলার।
৫. বেড়েই চলেছে ডলারের চাপ
চলতি অর্থবছরের প্রথমার্ধে (জুলাই-ডিসেম্বর) সরকার ও সরকারি গ্যারান্টিতে পাওয়া ঋণের যে ৩১৯ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করতে হবে তার ২৪৩ কোটি ডলার প্রকৃত হিসাব। বাকি ৭৬ কোটি ডলার সুদ।
৬. স্বল্প মেয়াদি বিদেশি ঋণ গ্রহণ ও ডলার সংকটের কারণ
চলতি বছরের প্রথম ছয় মাসে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তারা মোট ১ হাজার ৩৬৯ কোটি ডলারের বিদেশি ঋণ গ্রহণ করেন, বিপরীতে পরিশোধ করেন ১ হাজার ৬৭৪ কোটি ডলার। এর ফলে চলতি বছর প্রথম ছয় মাসে ঋণ নেওয়ার চেয়ে বেশি পরিশোধ করতে হয়েছে ৩০৫ কোটি ডলার।
ঋণের চিত্র বিশ্লেষণে দেখা যায়, বেসরকারি খাতের বিদেশি ঋণের মধ্যে শুধু ডেফার্ড পেমেন্ট বেড়েছে। মূলত ডলার সংকটে অনেক এলসি সময়মতো নিষ্পত্তি করা যায়নি। তাই ডেফার্ড পেমেন্ট বেড়ে গেছে। ২০২৩ সাল শেষে বাংলাদেশের বিদেশি ঋণের পরিমাণ ১১৫ বিলিয়ন ডলার ছাড়াবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। আর ২০২৪ সাল শেষে বিদেশি ঋণের পরিমাণ দাঁড়াবে ১৩০ বিলিয়ন ডলারে।
স্বস্তির বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপির অনুপাত এখনও নিরাপদ সীমায় রয়েছে, যা প্রায় ৩৭ শতাংশ। তবে দুঃখ জনক বিষয় হলো অনেক ব্যাংকই দেওলিয়া হয়ে যেতে পারে বলে অর্থনীতিবিদরা মনে করেন।