আজ সোমবার, ২৫ ভাদ্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।   ৯ সেপ্টেম্বর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও আমাদের করণীয়

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

বিধান চন্দ্র দাস:

‘বিগত ১৭৪ বছরের মধ্যে পৃথিবী তৃতীয়বার উষ্ণতম মে প্রত্যক্ষ করল।’ এই বাক্যটিকেই শিরোনাম হিসেবে ব্যবহার করে আমেরিকার ন্যাশনাল ওশানিক অ্যান্ড অ্যাটমোস্ফেরিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন (এনওএএ) গত ১৪ জুন ২০২৩ তারিখে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ শতকের তুলনায় গত মে ২০২৩-এ পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ০.৯৭ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি ছিল। উল্লেখ্য, বিশ শতকে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ছিল ১৪.৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। মার্চ থেকে মে ২০২৩ পর্যন্ত উত্তর গোলার্ধের বসন্ত ও দক্ষিণ গোলার্ধের শরৎ ছিল উল্লেখযোগ্য উষ্ণতায় ভরা। যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল সেন্টার্স ফর এনভাইরনমেন্টাল প্রেডিকশনের তথ্য নিয়ে গতকাল একটি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত খবরে বলা হয়েছে গত ৩ জুলাই সোমবার ছিল বিশ্বের উষ্ণতম দিন। ঐদিন বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ছিল ১৭.১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এর আগে ২০১৬ সালের আগস্টে সর্বোচ্চ ১৬.৯২ ডিগ্রি সেলসিয়াস গড় তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয়। গ্লোবাল অ্যানুয়াল টেম্পারেচার র্যাংকিংস আউটলুক (ন্যাশনাল সেন্টার ফর এনভায়রনমেন্টাল ইনফরমেশন) বলছে, ২০২৩ সাল হবে পৃথিবীর এ পর্যন্ত রেকর্ড করা ১০টি উষ্ণতম বছরের একটি, এমনকি প্রায় ৮৯ শতাংশ সম্ভাবনা আছে পাঁচটি উষ্ণতম বছরের মধ্যে একটি হওয়ারও। এনওএএ থেকে প্রশান্ত মহাসাগরে ‘এল নিনো’ চক্র শুরু হওয়ার ঘোষণাও দেওয়া হয়েছে। বর্তমান বৈশ্বিক ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার সঙ্গে এল নিনো প্রবলভাবে দেখা দিলে তার অভিঘাত মারাত্মক হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন। ধারণা করা হচ্ছে, এর ফলে আগামী বছর (২০২৪) হবে উষ্ণতম বছর। পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বেশি হয়ে যাবে। নাসার গোডারড ইনস্টিটিউট ফর স্পেস স্টাডিজ (জিআইএসএস) হিসাব দিয়েছে, ১৮৮০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ১.১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পেয়েছে। সব থেকে বেশি বৃদ্ধি ঘটেছে ১৯৭৫ সালের পর থেকে। প্রতি দশকে প্রায় ০.১৫ থেকে ০.২০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই হারে বৃদ্ধি অব্যাহত থাকলে আগামী ২০৩০ থেকে ২০৫০ সালের মধ্যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বৃদ্ধি পাবে। কিন্তু সেটি ২০৩০ সালের আগেই ২০২৪ সালে ঘটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। পৃথিবীর ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা ও আমাদের করণীয়সর্বশেষ গত ২২ মার্চ ২০২৩ জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আন্ত সরকার প্যানেল (আইপিসিসি) তাদের প্রতিবেদনে (ক্লাইমেট চেঞ্জ ২০২৩ : সিনথেসিস রিপোর্ট) দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেছে, মানুষের কর্মকাণ্ডের জন্যই বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বৃদ্ধি পেয়েছে। ২০১১ থেকে ২০২০ সালের মধ্যে এই বৃদ্ধির পরিমাণ (১৮৫০ থেকে ১৯০০ সালের তুলনায়) ১.০৯ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। ভূপৃষ্ঠ ও সমুদ্রে এই বৃদ্ধির পরিমাণ যথাক্রমে ১.৫৯ ও ০.৮৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড। কাজেই ২০২৪ সাল হঠাৎ করেই উষ্ণতম বছর হচ্ছে না, এটি আসলে বিগত কয়েক বছরের ধারাবাহিকতায় সৃষ্টি হচ্ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, ১ বা ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধি নিয়ে আমাদের এত মাথাব্যথা কেন? আমরা যে যেখানে বাস করি, সেখানে তো কয়েক ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা প্রতিদিনই ওঠানামা করে। আসলে স্থানীয় তাপমাত্রার ওঠানামা, যা অল্প সময়ের (রাত ও দিন, গ্রীষ্ম ও শীত) মধ্যে ঘটে, তার অভিঘাত বৈশ্বিক বা আঞ্চলিক তাপমাত্রা থেকে ভিন্ন। বৈশ্বিকভাবে ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার পরিবর্তন অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কারণ সব মহাসাগর, বায়ুমণ্ডল এবং স্থলভাগকে উষ্ণ করতে যে তাপের প্রয়োজন হয় তার জন্য বৈশ্বিক গড় তাপমাত্রা ১/২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। অতীতে ১ থেকে ২ ডিগ্রি তাপমাত্রা কমার জন্য পৃথিবী স্বল্পকালীন বরফ যুগে (লিটল আইস এজ) নিমজ্জিত হয়েছিল। ২০ হাজার বছর আগে ৫ ডিগ্রি তাপমাত্রা হ্রাসের কারণে উত্তর আমেরিকার একটি বিশাল অংশ বরফের নিচে ঢাকা পড়ে গিয়েছিল। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বৈশ্বিক মাত্র ০.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রার বৃদ্ধি মানুষ, জীবজগৎ তথা প্রকৃতির জন্য তাৎপর্যপূর্ণ অভিঘাত সৃষ্টি করতে পারে। আগে এত কম তাপমাত্রা পরিবর্তনের বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে দেখা হয়নি। বলা হচ্ছে, বৈশ্বিকভাবে অর্ধডিগ্রি কিংবা ১ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেলে তা প্রকৃতিতে ক্লাস্টার বোমার মতো পরিণাম ডেকে আনে। বর্তমানে মেরু বরফ বিগলন, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি, প্রাণী ও উদ্ভিদ প্রজাতি ধ্বংস, শস্য উৎপাদন হ্রাস, বাস্তুতন্ত্র পরিবর্তন, প্রবালপ্রাচীর বিনষ্ট হওয়ার মতো ঘটনাগুলো এ কারণেই ঘটছে। খরা, বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, দাবানল, বজ্রপাত ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘হিট-ওয়েভ’-এ আক্রান্ত হয়ে মানুষের মৃত্যুও হচ্ছে। তাপমাত্রা বৃদ্ধিতে সংশ্লিষ্ট রোগব্যাধিও বেড়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য জাতিসংঘ নানাভাবে কাজ করছে, বিশেষ করে বিগত কয়েক বছরে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের কয়েকটি জলবায়ু সম্মেলনে (কপ : কনফারেন্স অব দ্য পার্টিজ) এ ব্যাপারে নানা ধরনের চুক্তি সম্পাদিত হয়েছে। ২০১৫ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে (কপ-২১) বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তাপমাত্রার ওপরে ২ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের নিচে রাখা এবং তা ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখার জন্য প্রচেষ্টা গ্রহণ করার চুক্তি সম্পাদিত হয়েছিল। পরেও কয়েকটি সম্মেলনে (কপ ২২-২৭) এ ব্যাপারে নানা ধরনের চুক্তি হয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এতগুলো সম্মেলন ও চুক্তির পরও বৈশ্বিক তাপমাত্রা আশা অনুযায়ী সীমিত রাখা সম্ভব হয়নি। গত বছর (২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২) রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর বৈশ্বিক তাপমাত্রা সীমিত রাখার বিষয়ে নতুন করে অনিশ্চয়তা তৈরি হয়। কপ-২৭ (৬-২০ নভেম্বর ২০২২) উপলক্ষে জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস বলেছিলেন, ‘রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ আমাদের জলবায়ু পরিবর্তন রুখে দেওয়ার কার্যক্রমকে বাধাগ্রস্ত করছে (৩ অক্টোবর ২০২২)।’ যে সময় সবাই একসঙ্গে বৈশ্বিক উষ্ণতা রোধ তথা জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার জন্য ঝাঁপিয়ে পড়ার প্রয়োজন ছিল, ঠিক সেই সময় যুদ্ধ জয়ের উন্মাদনায় শক্তিধর দেশগুলোকে পেয়ে বসেছে। বিশ্ব এখন পারমাণবিক যুদ্ধের খুব কাছে চলে এসেছে। পৃথিবীর কোটি কোটি মানুষ যখন ক্ষুধা ও বিনা চিকিৎসায় মারা যাচ্ছে, তখন লক্ষ কোটি টাকা খরচ করা হচ্ছে তথাকথিত যুদ্ধ জয়ের জন্য। বৈশ্বিক উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মূলত গ্রিনহাউস গ্যাস দায়ী। জাতিসংঘ বলছে, বছরে ৩০ গিগাটন গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করতে পারলে বৈশ্বিক তাপমাত্রা প্রাক-শিল্প যুগের তুলনায় ১.৫ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেডের মধ্যে রাখা সম্ভব হবে। এর জন্য ছয়টি ক্ষেত্রে উপযুক্ত পরিবেশবান্ধব ব্যবস্থাপনা প্রয়োজন। এগুলো হচ্ছে—১. জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার কমিয়ে এনে নবায়নযোগ্য (জলবিদ্যুৎ, বায়ু, সৌর, পারমাণবিক, জিওথার্মাল ইত্যাদি) জ্বালানি ব্যবহার; ২. জৈব ও পুনরুৎপাদী কৃষি পদ্ধতি অনুসরণ এবং খাদ্য অপচয় নিয়ন্ত্রণ; ৩. সবুজ ভবন (নির্মাণ, ব্যবহার ও বিনষ্টকরণে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি ব্যবহার) ও শহর (পার্ক, বাগান ও জলাশয় বৃদ্ধিকরণ) দর্শন বাস্তবায়ন; ৪. বনভূমি রক্ষা; ৫. সবুজ যানবাহন (বিদ্যুৎ, হাইড্রোজেন, বায়োফুয়েল ইত্যাদি চালিত) ও সবুজ পরিবহন (ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে পাবলিক পরিবহনকে উৎসাহদান) ব্যবস্থা বাস্তবায়ন এবং ৬. কার্বন মূল্য (শিল্প-কলকারখানায় গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন মাত্রার ওপরে মূল্য ধার্য) নির্ধারণ ও বাস্তবায়ন। উল্লেখ্য, বিশ্বের অনেক জায়গায় এই ক্ষেত্রগুলোর ওপর কাজ হচ্ছে এবং কোনো কোনো দেশে একাধিক ক্ষেত্রে অগ্রগতি সন্তোষজনক। তবে বৈশ্বিকভাবে তা সন্তোষজনক নয়। বাংলাদেশ আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে ৬.৭৩ এবং ১৫.১২ শতাংশ গ্রিনহাউস গ্যাস যথাক্রমে শর্তহীন ও শর্ত সাপেক্ষে কমানোর প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেছে। আসলে বাংলাদেশকে উপরোক্ত ছয়টি ক্ষেত্রে তাৎপর্যপূর্ণ অর্জন পেতে হলে অনেক ধরনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। যেমন—বাংলাদেশে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারে ২০২১-২২ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ২.৫ শতাংশ অতিক্রম করতে পারেনি। দেশে জৈব কৃষি পদ্ধতি ব্যবহারের গতি খুবই মন্থর এবং পুনরুৎপাদী কৃষি পদ্ধতি (মাটি, জীববৈচিত্র্য ও জলাশয়কে স্বাস্থ্যময় রেখে এবং কার্বনকে মাটির গভীরে পাঠিয়ে ফসল উৎপাদন) এখনো চালু করা সম্ভব হয়নি। ভবন নির্মাণ, ব্যবহার ও বিনষ্টকরণে পরিবেশবান্ধব প্রযুক্তি সন্তোষজনকভাবে ব্যবহার সম্ভব হয়ে ওঠেনি। শহরগুলোর মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ পার্ক ও জলাশয়ের অভাব আছে। বন অধিদপ্তর নিয়ন্ত্রিত বনভূমির (১০.৭৪ শতাংশ) ব্যবস্থাপনা মোটামুটি সন্তোষজনক হলেও সরকার নিয়ন্ত্রিত বনভূমির (১৫.৫৮ শতাংশ) অবস্থা ভালো না। দেশে সবুজ যানবাহন ও সবুজ পরিবহন ব্যবস্থাও সেভাবে গড়ে উঠছে না। দেশে কার্বন মূল্য বা ট্যাক্স ধার্য ও বাস্তবায়ন করাও খুব সহজ কাজ নয়। বাংলাদেশে উপরোক্ত চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করার জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এল নিনো ও ক্রমবর্ধমান উষ্ণতা–এই দুটিকেই বিবেচনায় নিয়ে জরুরি ভিত্তিতে তার জন্য কাজ করা দরকার। মনে রাখা প্রয়োজন, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার ছাড়া এল নিনো ও ক্রমবর্ধমান উষ্ণতার অভিঘাত থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে না।

লেখক : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়

- Advertisement -
- Advertisement -