[bangla_time] | [bangla_day] | [bangla_date] | [english_date] | [hijri_date]

বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের সময় এখন

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

গাজীউল হাসান খান:

বর্তমান সময়টি বিশ্ব ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় হিসেবে সর্বত্র বিবেচিত হচ্ছে। এ সময়ে এসে একে একে উদঘাটিত হচ্ছে মানবতার ইতিহাসের বেশ কিছু ন্যক্কারজনক কিংবা জঘন্য ঘটনা, যা অবিলম্বে পরিবর্তন কিংবা সংশোধনের দাবি রাখে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর থেকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ক্রমে ক্রমে অন্যতম প্রধান পরাশক্তি হয়ে ওঠা, পুঁজিবাদী অর্থনীতির ভিত্তিতে শোষণ-শাসনের সব ব্যবস্থাকে চূড়ান্ত পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া কিংবা সাম্রাজ্যবাদের কুিসত চেহারাকে স্বরূপে প্রকাশ করার প্রয়াস পেয়েছে বিগত এই কালটি। পাশাপাশি বিশ্বব্যাপী মানুষের আর্থ-সামাজিক মুক্তির লক্ষ্যে সংঘটিত সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব পর্যায়ক্রমিক স্খলনের ধারাবাহিকতায় আজ প্রায় বিপন্ন হয়ে পড়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। সার্বিকভাবে আধিপত্য বিস্তারের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতা কথিত দুটি শিবিরকেই আজ গণতন্ত্র কিংবা মানবাধিকার লুণ্ঠন এবং অন্যদিকে অর্থনৈতিক মুক্তি অর্জনের স্বপ্নকে ধূলিসাৎ করেছে বলে সর্বত্র প্রতিবাদ ও প্রতিরোধ গড়ে তোলা হচ্ছে। মুক্তিকামী মানুষ সর্বত্র আজ এর অবসানকল্পে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। সবাই চায় এক সময়োপযোগী পরিবর্তন। এককেন্দ্রিক ক্ষমতার বলয় ও সামরিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা, এমনকি বিশ্ববাণিজ্যে বিনিময় মুদ্রা হিসেবে ডলারের একাধিপত্য রোধকল্পেও সাধারণ মানুষ আজ একাত্ম হয়ে উঠেছে। প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠছে সাম্রাজ্যবাদ কিংবা আধিপত্যবাদ রোধকল্পে রাশিয়ার শাসক পুতিনের প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানি গড়ে তোলার বিরুদ্ধে। আন্তর্জাতিক আইন কিংবা রাশিয়ার আইনেও নিষিদ্ধঘোষিত এই বাহিনী এক দশকের অধিক কাল ধরে, বিশেষ করে আফ্রিকার বিভিন্ন অঞ্চল এবং ইরাক, সিরিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন রণক্ষেত্রে ‘প্রক্সি ওয়ার’ চালিয়ে যাচ্ছে। অথচ উল্লিখিত সেসব অঞ্চলের মানুষ আজও পরিষ্কারভাবে কোনো মুক্তির পথ বা আলো দেখতে পাচ্ছে না। উল্লিখিত অঞ্চলগুলোতে পরাশক্তিগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়া তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই এই অন্যায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে, মানুষের মুক্তির জন্য নয়। বিশ্বব্যবস্থা পরিবর্তনের সময় এখননিজের প্রভাব, প্রতিপত্তি ও আধিপত্য প্রতিষ্ঠার স্বার্থে যুক্তরাষ্ট্র ইউরোপীয় ইউনিয়নকে সামনে রেখে রাশিয়ার বিরুদ্ধে পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোকে ব্যবহার করছে। রাশিয়াকে খণ্ড-বিখণ্ড কিংবা আর্থ-সামরিক দিক থেকে দুর্বল করে দেওয়ার জন্য ইউক্রেনে উসকানিমূলকভাবে সংঘর্ষ বাধিয়েছেন সাম্রাজ্যবাদী প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। ইউক্রেনে সংঘটিত বর্তমান বিরোধ একটি নেহাত সামরিক সংঘর্ষ নয়। এটি একটি পূর্ণাঙ্গ প্রক্সি ওয়ার, যাতে সামরিক-অসামরিক সব রসদ ও যুদ্ধ সরঞ্জাম পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় বশংবদরা। এই অন্যায়ের বিরুদ্ধে আরো একটি বড় বেআইনি কাজ করেছে রাশিয়া।রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বেআইনিভাবে গঠিত প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানির সশস্ত্র যোদ্ধা কিংবা ভাড়াটে বাহিনীকে ইউক্রেনে পাঠিয়েছে প্রেসিডেন্ট ভোলোদিমির জেলেনস্কিকে শিক্ষা দিতে। অন্যদের মধ্যে ক্রিমিয়া দখলের দায়িত্ব দিয়ে ২০১৪ সালে তাঁর ঘনিষ্ঠ শিষ্য ইয়েভনি প্রিগোশিনের ওয়াগনার প্রাইভেট বাহিনীকে পাঠিয়েছিলেন, যার সামরিক প্রশিক্ষণ ও নেতৃত্বে ছিলেন লে. কর্নেল দিমিত্রি উটকিন। বেআইনি প্যারামিলিটারি বাহিনীর প্রশিক্ষক এই উটকিনকে পরবর্তীকালে একজন জাতীয় বীর হিসেবে পুরস্কৃত করেছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। আর আজন্ম আইন অমান্যকারী, অপরাধী ও বাউণ্ডুলে স্বভাবের ইয়েভনি প্রিগোশিন ছিলেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের দীর্ঘদিনের কুকর্মের সহযোগী। বিভিন্ন অপরাধে দীর্ঘদিন জেল খেটে মুক্ত হলে পুতিনের সংস্পর্শে আসেন প্রিগোশিন। পুতিন প্রথমে তাঁকে রাশিয়ার সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি খাবারের রেস্টুরেন্ট চালু করতে সাহায্য করেন। ক্রমে ক্রমে প্রিগোশিন একজন খাবার সরবরাহকারী এবং পুতিনের প্রিয় বাবুর্চি হিসেবে খ্যাতি লাভ করেন। এর প্রায় অর্ধদশক পর প্রিগোশিন সেন্ট পিটার্সবার্গে একটি প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানি প্রতিষ্ঠা করে সদস্য রিক্রুট করা শুরু করেন, যা ১০ হাজার থেকে ২৫ হাজারে উন্নীত হয়। শুধু তা-ই নয়, ইউক্রেন যুদ্ধের প্রাক্কালে রাশিয়ার বিভিন্ন জেল থেকে তরুণ অপরাধীদের সাজা মওকুফ ও নিয়মিত বেতন দেওয়ার প্রতিশ্রুতিতে সামরিক প্রশিক্ষণ দেওয়া শুরু হয়েছিল। তারপর প্রিগোশিনের ওয়াগনার বাহিনীর সদস্যসংখ্যা ৫০ হাজারের কাছাকাছি চলে যায়। সেই বাহিনীকে প্রতিপক্ষরা পুতিনের ব্যক্তিগত বাহিনী বলে আখ্যায়িত করেছে। ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোশিনের কোনো প্রথাগত সামরিক প্রশিক্ষণ ছিল না। এমনকি বাবুর্চি হিসেবে তাঁর কোনো প্রশিক্ষণ ছিল না। শুধু প্রেসিডেন্ট পুতিনের সদিচ্ছায়ই প্রিগোশিন এতটা উন্নতি লাভ করেছিলেন। ওয়াগনারের মতো প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানির অভাব নেই আজকের রাশিয়ায়। এরা সবাই বিভিন্ন খাতে প্রদত্ত সরকারি অর্থে পরিচালিত হচ্ছে। এসব প্যারামিলিটারি বা প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানির ভাড়াটে সদস্যরা প্রায় এক বছরের বেশি সময় ধরে আফ্রিকার ইরিত্রিয়া থেকে মালি, সেন্ট্রাল আফ্রিকান রিপাবলিক থেকে উত্তর আফ্রিকার লিবিয়া ও মধ্যপ্রাচ্যের সিরিয়া পর্যন্ত রুশ সরকারের প্রক্সি ওয়ার চালিয়ে গেছে। সেখান থেকে কখনো ক্রিমিয়া এবং শেষ পর্যন্ত ইউক্রেনের রুশভাষী অধ্যুষিত দনবাস প্রদেশে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের পক্ষ হয়ে সংঘর্ষ চালিয়ে গেছে এবং ক্রিমিয়ার মতো লুহানস্ক ও বাথমুখে সাফল্য লাভ করেছে। সে সাফল্যই শেষ পর্যন্ত তাদের জন্য কাল হয়ে দাঁড়ায়। তারা আরো অধিক অর্থ লাভের লোভে ইউক্রেনে যুদ্ধ পরিচালনার ক্ষেত্রে রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রীর সরাসরি বিরোধিতা শুরু করে। তাদের আরো বেশি অর্থ দেওয়া হলেও তারা রুশ সামরিক কর্তৃপক্ষকে অগ্রাহ্য করে সরকারি বাহিনীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন স্থানে প্রতিপক্ষ হয়ে দাঁড়ায়। তারা শুধু রুশ প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ই নয়, এক পর্যায়ে সামরিক কর্তৃপক্ষ এবং প্রেসিডেন্ট পুতিনকেও অগ্রাহ্য করার দুঃসাহস দেখায়। এতে ধৈর্য হারিয়ে ফেলেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। দনবাসসহ ইউক্রেনের দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চলের অনেক অবস্থানে তাদের বিরুদ্ধে সামরিক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল এবং এমনকি গোলাবর্ষণও করা হয়েছিল তাদের ওপর। এতে খেপে যান ওয়াগনার বাহিনীর প্রধান প্রিগোশিন এবং রুশ সরকারের নির্দেশ মানতে অস্বীকৃতি জানান। প্রিগোশিন বিদ্রোহ ঘোষণা করেন রুশ প্রতিরক্ষা বাহিনীর বিরুদ্ধে এবং মস্কো অভিমুখে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নেন। পথে রস্টভ অন ডন সামরিক ঘাঁটি দখল করেন। এতে তাঁর বিরুদ্ধে চূড়ান্ত ব্যবস্থা নেওয়ার ঘোষণা দেন প্রেসিডেন্ট পুতিন। শেষ পর্যন্ত বেলারুশের প্রেসিডেন্ট আলেকজান্ডার লুকাশেংকোর মধ্যস্থতায় প্রিগোশিনসহ তাঁর বাহিনীকে তাঁর দেশে আশ্রয় দেওয়া হয়। বলা হয়েছে, ওয়াগনার বাহিনীর উপযুক্ত সদস্যদের রুশ বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত এবং প্রিগোশিনকে ক্ষমা করা হতে পারে। প্রিগোশিনের বিদ্রোহের পেছনে যুক্তরাষ্ট্রের কোনো যোগসূত্র আছে কি না, জানা না গেলেও ইউরোপের কোনো ইশারা নেই বলে জানানো হয়েছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের পররাষ্ট্রবিষয়ক প্রধান জোসেফ বোরেল বলেছেন, ওয়াগনার বিদ্রোহের কারণে পুতিন আরো বেশি দৃঢ়চেতা হয়ে উঠবেন। কিন্তু ন্যাটোর মহাসচিব জেমস স্টলটেনবার্গ বলেছেন সম্পূর্ণ ভিন্ন কথা। তিনি উক্তি করেছেন, ওয়াগনার বিদ্রোহের কারণে রাশিয়ায় ফাটল ধরেছে এবং দেশটি ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যাপারে বিভক্ত হয়ে পড়েছে। এ ঘটনায় ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কি বলেছেন, বিদ্রোহ পুতিনকে আরো বিপজ্জনক করে তুলবে। তবে রাশিয়া দুর্বল হলে বাকিরা নিরাপদ হবে বলে তাঁর ধারণা। রাশিয়ার পরাজয় যুদ্ধের অবসান ঘটাবে। এ ছাড়া ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের প্রক্রিয়া বলবৎ রয়েছে। ১১ ও ১২ জুলাই ন্যাটোর অনুষ্ঠেয় সম্মেলনে ইউক্রেনকে সদস্য পদ দেওয়া না হলেও কিভাবে আরো সামরিক ও অসামরিক সাহায্য দেওয়া যায়, সেটি নিয়ে চিন্তা-ভাবনা চলছে। এরই মধ্যে রুশ জেনারেল সের্গেই সুরেভিকিনসহ আরো কয়েকজন দায়িত্বপ্রাপ্ত সামরিক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে সাম্প্রতিক ঘটনায় বিভিন্ন অভিযোগ আনা হয়েছে, যা তদন্তাধীন এখনো। ওয়াগনার প্রাইভেট মিলিটারি কম্পানির প্রধান প্রিগোশিনের সাম্প্রতিক বিদ্রোহ ও রুশ সরকারের বিভিন্ন বেআইনি ও অন্যায্য কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে বিভিন্ন অভিযোগ এখন বিশ্বের সর্বত্রই আলোচিত হচ্ছে। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ ও তার অনুসারীদের বিভিন্ন কার্যক্রমের বিরুদ্ধে আলোচনা-সমালোচনা অব্যাহত রয়েছে। একবিংশ শতাব্দীর এই পর্যায়ে গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং সর্বোপরি বিশ্বশান্তির বৃহত্তর স্বার্থে এসব আধিপত্যবাদী ও কর্তৃত্বপরায়ণ ন্যক্কারজনক কার্যকলাপ আর চলতে দেওয়া যেতে পারে না। সে কারণেই এ লেখার প্রারম্ভে বলা হয়েছে, বর্তমান সময়টি বিশ্ব ইতিহাসের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ক্ষণ। যুক্তরাষ্ট্র কিংবা রাশিয়ার সব অনৈতিক ও বেআইনি কার্যকলাপ এবং লড়াইয়ের এই মুহূর্তে অবসান ঘটা আবশ্যক। কারো পরাশক্তিগত লড়াইয়ে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন বিশ্বমানবতার মুক্তি অর্জন ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় কোনো সহায়ক ভূমিকা পালন করবে না। এতে বরং পারমাণবিক অস্ত্রের আঘাতে পৃথিবী ধ্বংস হবে, নিশ্চিহ্ন হবে বিশ্বের নিরাপদ জনপদ।

লেখক : বাংলাদেশ সংবাদ সংস্থার (বাসস) সাবেক প্রধান সম্পাদক ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক

- Advertisement -
- Advertisement -