ত্রিপুরারী দেবনাথ তিপু:
হবিগঞ্জের কৃতি সন্তান ও মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্তের মৃত্যু বার্ষিকী আজ।
জেলার চুনারুঘাটের মিরাশী একটি গ্রামের নাম। একটি অভিজাত গ্রাম। একটি শিক্ষিত গ্রাম। গ্রামটির অবস্থান হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট থানায়। মিরাশী গ্রামে জন্ম গ্রহন করেছিলেন বৃটিশ আমলের শিক্ষা মন্ত্রী রায়বাহাদুর এডভোকেট প্রমোদ চন্দ্র দত্ত,সিলেট বিভাগের প্রথম গায়িকা বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্নেহধন্যা অমলা দত্ত কুইনী, রায়সাহেব মহেন্দ্র দত্ত, কলকাতা ভিক্টোরিয়া কলেজের প্রিন্সিপাল সুপ্রভা দত্ত, গণসংগীতের হারকিউলিকস ও আন্তর্জাতিক গণনাট্য সঙ্গীত শিল্পী হেমাঙ্গ বিশ্বাস,আসামের পুলিশের আইজি দীনেশ দত্ত। এই মিরাশী গ্রামের সন্তান হলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৪ নং সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল সি আর দত্ত।
পুরো নাম চিত্ত রঞ্জন দত্ত। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার। ৪নং সেক্টরের সেক্টর কমান্ডারের দায়িত্ব পালন করেছেন। মুক্তিযুদ্ধে অবদানের জন্য “বীর উত্তম “খেতাবে ভূষিত হয়েছেন।’একজন খেতাবপ্রাপ্ত মুক্তিযোদ্ধা। খেতাব নম্বর-১১। সেক্টর কমান্ডার্স ফোরামের সাথে যুক্ত ছিলেন। ১৯৭২ সালের সংবিধানে বিশ্বাসী। অসাম্প্রদায়িক চেতনায় বিশ্বাসী একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা।
১৯২৭ সালের ১ জানুয়ারি চিত্ত রঞ্জন দত্তের জন্ম আসামের শিলংয়ে। তার পৈতৃক বাড়ি হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার মিরাশি গ্রামে। তার বাবার নাম উপেন্দ্র চন্দ্র দত্ত এবং মায়ের নাম লাবণ্য প্রভা দত্ত।
শিলংয়ের ‘লাবান গভর্নমেন্ট হাইস্কুলে’ দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করেছিলেন৷ পরবর্তীকালে তাঁর বাবা চাকরি থেকে অবসর হবার পর হবিগঞ্জ শহরে এসে স্থায়ী বসবাস শুরু করেন৷
১৯৪৪ সালে হবিগঞ্জ গভর্নমেন্ট হাই স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে মাধ্যমিক পাশ করেন। কলকাতার আশুতোষ কলেজে বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হয়ে পড়াশুনা শুরু করেন।এরপর চলে আসেন খুলনায়। খুলনার দৌলতপুর কলেজের বিজ্ঞান শাখায় ভর্তি হন৷
১৯৪৬ সালে খুলনার দৌলতপুর কলেজ উচ্চ মাধ্যমিক পাশ করেন। ১৯৪৮ সালে খুলনা থেকে বিএসসি পাশ করেন৷ ১৯৫১ সালে চিত্ত রঞ্জন দত্ত পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগ দেন৷ ‘সেকেন্ড লেফটেনেন্ট’ পদে কমিশন পান।
১৯৫৭ সালে মাধবপুর থানার বেঙ্গাডুবা গ্রামের বিখ্যাত কায়স্ত পরিবারের মেয়ে মনীষা রানী রায়কে বিয়ে করেন। মনীষা ছাত্রী অবস্থায় হবিগঞ্জ শহরে বৃটিশ বিরোধী মিছিল করতে গিয়ে গ্রেফতার হয়ে কারাবরন করেন। মনীষার বাবা অর্থাৎ সি আর দত্তের শ্বশুর সাংবাদিক অনিল কুমার রায় ছিলেন দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের একান্ত সচিব ( পি এস) । ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধে পাকিস্তানের হয়ে আসালংয়ে একটা কোম্পানির কমান্ডার হিসেবে যুদ্ধ করেন। এই যুদ্ধে বীরত্বপূর্ণ অবদানের জন্য ক সংবাদ পেয়ে সি আর দত্ত তৎক্ষনাৎ চলে আসেন। সি আর দত্তের আগমনে উপস্থিত জনতা ” জয় বাংলা” শ্লোগান দিয়ে আনন্দ উল্লাস প্রকাশ করতে থাকেন। জনগণের এই উচ্ছাসে তিনি উৎফুল্লু হয়ে উঠেন। মেজর সি আর দত্ত হাত তুলে সবাইকে অভিবাদন জানান। সেদিনই বিকেল পাঁচটায় ট্রেজারীর অস্ত্র নিয়ে হবিগঞ্জের মুক্তিপাগল মানুষদেরকে নিয়ে সিলেটের প্রথম প্রতিরোধ যুদ্ধের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন। শেরপুর, সাদিপুরের যুদ্ধে হবিগঞ্জের মেজর সি আর দত্তের এই বাহিনী পাকিস্তানী শত্রুর বিরুদ্ধে প্রথম সম্মুখ যুদ্ধে লিপ্ত হয়।
১৯৭১ সালের ৪ এপ্রিল হবিগঞ্জ জেলার মাধবপুর থানায় তেলিয়াপাড়া চা বাগানে বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য ঐতিহাসিক এক গোপন শপথ অনুষ্টিত হয়। এই শপথ অনুষ্টানে ২৭ জন সেনাকর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন কর্ণেল এম এ জি ওসমানী, কর্ণেল এম এ রব,লেঃ কর্ণেল সালাউদ্দিন মোহাম্মাদ রেজা, মেজর কে এম শফি উল্লাহ, মেজর খালেদ মোশারফ, মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত, মেজর জিয়াউর রহমান,মেজর আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর নুরুল ইসলাম, মেজর শাফায়াত জামিল, মেজর কাজী নুরুজ্জামান, ক্যাপ্টেন নাসিম,ক্যাপ্টেন সুবিদ আলী ভুইয়া, ক্যাপ্টেন মইনুল হোসেন চৌধুরী, ক্যাপ্টেন মতিন,লেঃ মাহবুব,লেঃ আনিস,লেঃ সেলিম,লেঃ কাজী কবীর উদ্দিন, ভারতের পুর্বাঞ্চলীয় বি এস এফের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার ভিসি পান্ডে,আগরতলার জেলা ম্যাজিষ্ট্রেট ওমেস সায়গল।
১৯৭১ সালের ১০ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠিত হওয়ার পর তাজউদ্দীন আহমেদকে প্রধানমন্ত্রী মনোনীত করা হয় এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি হিসেব দায়িত্ব দেয়া হয় এমএজি ওসমানীকে। মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে ভাগ করা হয়।
৪ নং সেক্টর গঠিত হয় হবিগঞ্জ জেলা ও সিলেটের অংশ নিয়ে। মেজর চিত্তরঞ্জন দত্ত ছিলেন ৪ নং সেক্টরের কমান্ডার। সেই সেক্টর এলাকায় নিয়মিত ১৫০০ সৈন্যর পাশাপাশি প্রায় ৯০০০ গণযোদ্ধা সক্রিয়ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অংশ গ্রহন করেন।
সিলেট জেলার পূর্বাঞ্চল এবং খোয়াই শায়স্তাগঞ্জ রেল লাইন বাদে পূর্ব ও উত্তর দিকে সিলেট ডাউকি সড়ক পর্যন্ত এলাকা নিয়ে ৪নং সেক্টর গঠন করা হয়। সেক্টর কমান্ডার সি আর দত্ত দায়িত্ব পাওয়ার পর সিলেটের রশীদপুরে প্রথমে ক্যাম্প তৈরী করেন। চারপাশের বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে চা বাগান৷ চা বাগানের আড়ালকে কাজে লাগিয়ে তিনি যুদ্ধের কৌশল নির্ধারণ করে দিতেন৷ পরবর্তী সময়ে তিনি যুদ্ধের আক্রমণের সুবিধার্থে রশীদপুর ছেড়ে মৌলভীবাজারে ক্যাম্প স্থাপন করেন৷ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ৩১ পাঞ্জাব রেজিমেন্ট বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে ধংসাত্মক কার্যাক্রম শুরু করে। মেজর সি আর দত্ত ৯ ম এবং ১৬ তম পদাতিক ডিভিশন থেকে অতিরিক্ত সেনা মোতায়েন করেন। রশীদপুর চাবাগানে সামরিক ঘাটি স্থাপন করে প্রতিরোধ যুদ্ধ চালাতে থাকেন।
১৯৭১ সালে আগষ্ট মাসের শেষ দিকে লেঃ কর্ণেল পদে পদোন্নতি পান। ভারতীয় সেনাবাহিনীর তাঁর নেতৃত্বে মুক্তিযোদ্ধার ৬ টি ১০৫ মিমি কামান প্রদান করে। এই কামান দিয়ে মুক্তিযুদ্ধকালীন দ্বিতীয় ফিল্ড আর্টিলারী ইউনিট গঠন করেন।এই আর্টিলারী ইউনিট ৪ নং সেক্টর এলাকায় ব্যাপক ফায়ার সাপোর্ট প্রদান করে চুড়ান্ত বিজয়কে ত্বরাম্বিত করে।
লেঃ কর্ণেল সি আর দত্তের পরিকল্পনা ও নেতৃত্বে ৪ নং সেক্টর এলাকায় অনেক যুদ্ধ সংগঠিত হয়। উল্লেখ যুদ্ধ হচ্ছে কানাইঘাটের থানা যুদ্ধ, নান্দুয়ার যুদ্ধ,শমসেরনগর যুদ্ধ। সিলেটের অধিকাংশ এলাকা নিজের দখলে নিয়ে আসেন। মুক্তিযুদ্ধে প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত ৪ নং সেক্টর কমান্ডার ছিলেন। ১৯৭২ সালে সি আর দত্ত রংপুরে ব্রিগেড কমান্ডার হিসেবে নিযুক্ত হন৷ সেখানে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখেন৷ ১৯৭৩ সালে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্য সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সরকার৷ এই বিষয়ে চিত্ত রঞ্জন দত্তকে দায়িত্ব দেয় বাংলাদেশ সরকার৷ পরবর্তীকালে তিনি সীমান্ত রক্ষা প্রহরী গঠন করেন। সি আর দত্ত নাম দেন “বাংলাদেশ রাইফেলস”। বর্তমানে এ বাহিনীর নাম বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ। চিত্ত রঞ্জন দত্ত ছিলেন বাংলাদেশ রাইফেলসের প্রথম ডাইরেক্টর জেনারেল ( ডিজি)।
১৯৭৪ সালে হেড কোয়ার্টার চিফ অব লজিস্টিক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন৷ ১৯৭৭ সালে মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন৷
১৯৭৯ সালে বিআরটিসির চেয়ারম্যান হন। ১৯৮২ সালে পুনরায় মুক্তিযোদ্ধা কল্যাণ ট্রাস্টের চেয়ারম্যান হন৷ ১৯৮৪ সালে এরশাদ সরকারের আমলে মেজর জেনারেল পদে থাকা অবস্থায় বাধ্যতামুলক অবসর দেয়া হয়।
১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের ৮ ম সংশোধনীর প্রতিবাদ করলে তৎকালীন স্বৈরাচার প্রেসিডেন্ট এরশাদের গুন্ডা বাহিনী মেজর জেনারেল সি আর দত্তের গাড়ীতে বোমা বিস্ফোরন ঘটালে গুরুতর আহত হন। বিদেশে চিকিৎসার করার পর সুস্থ হয়ে উঠেন।
১৯৮৮ সালে প্রতিষ্টা করেন বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খৃষ্টান ঐক্য পরিষদ। যার লক্ষ্য ছিল মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ১৯৭২ সালের সংবিধান বাস্তবায়ন করা। তিনি ছিলেন সংগঠনের আজীবন সভাপতি। ২০১০ সালের ১৪ নভেম্বর মেজর জেনারেল সি আর দত্তের স্ত্রী মনীষা দত্ত মৃত্যুবরন করেন। স্ত্রীর মৃত্যুর পর ঢাকা বনানীর বাসায় তিনি একাকী হয়ে পড়েন। ২০২০ সালের ২০ আগষ্ট আমেরিকার ফ্লোরিডার মেয়ের বাসায় থাকা অবস্থায় বাথরুমে পড়ে যান। স্বজনরা হাসপাতালে নিয়ে যাবার পর কোমায় চলে যান। আর জ্ঞান ফেরেনি। ২০২০ সালের ২৫ আগষ্ট বাংলাদেশ সময় সকাল ৯টায় বীর মুক্তিযোদ্ধা মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর ইচ্ছে ছিলো প্রিয় মাতৃভূমিতে বাংলাদেশ হবে শেষ বিদায়ের কাজ। সেই ইচ্ছের প্রতি সম্মান জানিয়ে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার সিআর দত্তের মরদেহ বাংলাদেশে আনা হয়। ২০২০ সালের ৩১ আগষ্ট এমিরেটস’র এয়ার লাইন্সের ০৫৮২ নম্বরের বিমান যোগে সকাল ৮ টা ৪০মিনিটে আমেরিকার ফ্লোরিডা থেকে ঢাকা বিমান বন্দরে মরদেহ পৌঁছে।
ঢাকা বিমান বন্দর থেকে মেজর জেনারেল সি আর দত্তের মরদেহ সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালের (সিএমএইচ) হিমাগারে রাখা হয়। ২০২০ সালের ১ সেপ্টেম্বর সকাল সাড়ে ৭ টায় তাঁর ঢাকা বনানিস্থ ডিওএইচ এর ২নম্বর সড়কের ৪৯ নম্বর বাড়ীর বাসভবন হয়ে সর্বসাধারণের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য রাখা হয়। এরপর মরদেহ ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বরে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে বীর মুক্তিযোদ্ধাকে রাষ্ট্রীয় সম্মাননা প্রদান করা হয়। ঢাকেশ্বরী মন্দির চত্বর থেকে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় রাজারবাগ বরদেশ্বরী শ্মশানে। সেখানে শেষকৃত্যানুষ্ঠানের আগে মেজর জেনারেল দত্তের মরদেহের প্রতি সামরিক সম্মাননা জ্ঞাপনের জন্য গানস্যালুট প্রদান করা হয়।
ঢাকায় সবুজবাগ বদরেশ্বরী শ্মশানে দাহ করা হয় ১৯৭১ সালের বীরমুক্তিযোদ্ধা ও সেক্টর কমান্ডারকে। তিন মেয়ে ব্যারিষ্টার চয়নিকা দত্ত,মহুয়া দত্ত,কবিতা দত্ত, একমাত্র ছেলে চিরঞ্জীব দত্ত। মেয়ে ব্যারিষ্টার চয়নিকা দত্ত কানাডা প্রবাসী। সবাই আমেরিকা প্রবাসী।
রাজধানী ঢাকার কাঁটাবন থেকে কারওয়ান বাজার সিগন্যাল পর্যন্ত সড়কটি ‘বীরউত্তম সি আর দত্ত’ সড়ক নামে নামকরণ করা হয়।
আলোকিত প্রতিদিন/ ২৪ আগস্ট ,২০২২/ মওম
- Advertisement -