আজ শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০ বঙ্গাব্দ ।   ২৯ মার্চ ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

নিরাপত্তা প্রহরী/ সৈয়দ রনো

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

নিরাপত্তা প্রহরী

সৈয়দ রনো

অভাব অনটন যাদের নিত্যসাথী তাদের আবার জীবন-সংসার। সুখবোধ কানাগলিতে লুকিয়ে থাকে। এক সময় দুঃখ কষ্ট হয়ে উঠে প্রতিদিনের রোজ নামচা। টাকার অভাবে আপনজনও দিন দিন পর হতে থাকে। শুনতে হয় নানা রকম অসহ্যমূলক কথা। নুন আনতে পান্তা ফুরায়, একপেট ভাতের জন্য অন্যের বাড়ি বাড়ি গিয়ে কাজ করে দিতে হয়। নানা রকম সমস্যায় জর্জরিত একটি পরিবারে অনেক দুঃখ কষ্টে বেড়ে উঠেছে ওমর ফারুক। সুখের সান্নিধ্য না পেলেও অন্যের বাড়িতে কাজ করে এসএসসি পাশটা করেছে। ঘরে অসুস্থ বাবার সেবা-যত্ন করতে করতে মাও শারিরীকভাবে অসুস্থ। এতো এতো পাহাড় সমেত সমস্যার মধ্যেও ধর্মীয় মূল্যবোধকে সমুন্নত রাখতে শিখেছে আরবি শিক্ষা। দুঃখ কষ্টে সারাক্ষণ বুকের ভেতর রক্তক্ষরণ হলেও আদব আজিজি তার নিত্য সাথী। সবার সাথে হাসি মুখে কথা বলাটাই যেনো তার প্রধান কাজ। ছোট বড় যে কারো আদেশ-নির্দেশ পালনে সদা প্রস্তুত ওমর ফারুক। চলন-বলন দেখে কেউ বুঝতে পারেন না তার মনের জমিন, ভেঙ্গে চুরে হয়েছে খানখান।
সময়ের পাখায় ভর করে যৌবনে বেড়ে উঠে ওমর ফারুক। দেখতে শুনতে সুপুরুষ বটে। জীবন এবং জীবিকা নিয়ে ভাবতে গিয়ে এক ধান্দাবাজের খপ্পরে পরে ওমর ফারুক। বাবা মায়ের দূর্গতি সার্বক্ষণিক মাথার মধ্যে ঘুরতে থাকে। নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে ঢাকায় এসে এক সিকিউরিটি কোম্পানীতে চাকুরি নেয়। সিকিউরিটি কোম্পানী লোক সাপ্লাই দিতে গিয়ে ওমর ফারুককে ঠেলে দেয় মৃত্যুর মুখে। জমি নিয়ে বিরোধে জড়িয়ে পরে। মধ্যযুগের কৃতদাস বিক্রির মতো সিকিউরিটি কোম্পানীও তাকে বিক্রি করে এক রিয়েল এস্টেট কোম্পানীর কাছে। রিয়েল এস্টেট কোম্পানী ওমর ফারুককে দিয়ে দিন রাত চব্বিশ ঘণ্টা, যখন যেভাবে খুশি কাজ করিয়ে নেয়। নৈতিক, অনৈতিক সব কাজই তাকে করতে হয়। বেতনও তেমন না, কোনরকম পেটে ভাতে চলে যাচ্ছে। মুখ বুজে সবকিছু সহ্য করে কাজ করতে থাকে ওমর ফারুক। কাজের ফাঁকে ফাঁকে ভাবে, হয়তো আমি কৃতদাস, হয়তো এটাই বিধির বিধান। কানাগলির দূর্বিসহ অন্ধকার হতে বের হওয়া হয়তো আর সম্ভব নয়। মালিক পক্ষের সব আদেশ পালন করতে থাকে ওমর ফারুক। নম্রতা এবং সভ্যতা ওমর ফারুকের অঙ্গের ভীষণ। কোম্পানীর এমডি হামিদ সাহেব অত্যন্ত চতুর এবং বদমেজাজী। দীর্ঘদিন জমির পাহারাদার হিসেবে কাজ করার পর অন্য দশজন সিকিউরিটি গার্ডের চেয়ে কাজে দক্ষতার পরিচয় দেয় ওমর ফারুক। হামিদ সাহেব ওমরের কাজে অন্ত্যন্ত সন্তুষ্ট। এ রকম ওবিডেন্ট নিরাপত্তা প্রহরী তার কপালে আর জোটেনি। সবাই যেখানে কাজে ফাঁকি দেয়ার ধান্দা ফিকির নিয়ে থাকে, সেখানে ওমর ফারুক সাধ্যমতো অর্পিত দায়িত্ব পালনে সদা স্বচেষ্ট। হঠাৎ একদিন এমডি হামিদ সাহেব তার কক্ষে ডেকে পাঠায় ওমর ফারুককে। ওমর ফারুকের মনের কুল ভেঙ্গে হতে থাকে চৌচির। মনে মনে ভাবতে চেষ্টা করে, কোথায়ও ভুল ত্রুটি হলো কী না। না, কোথায়ও কোন কাজে ব্যাঘাত ঘটেছে বলে মনে করতে পারছে না। ইতোমধ্যেই সে অবগত হয়েছে, এমডির রুমে যার ডাক পরেছে তার চাকরি হতে ছাটাইয়ের কাগজ হাতে ধরিয়ে দিয়েছেন। ওমর ফারুক নিশ্চিত, এ কোম্পানীতে তার আর চাকরি নেই। পাঁচ ফিট ছয় ইঞ্চি লম্বা ওমর ফারুক কোম্পানীর পোষাক পরিহিত অবস্থায় ভয়ে ভয়ে এমডির রুমে ঢোকে। ঢুকেই স্যালুট দেয় এমডি সাহেবকে। বুক টান করে স্যালুট দেয়া অবস্থায় অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এমডি একটি চিঠিতে সাক্ষর করে পিএস এর উদ্দেশ্যে দিয়ে দেন। হামিদ সাহেব ওমর ফারুককে আপাদমস্তক খুটিয়ে খুটিয়ে দেখে। বেতের লাঠিটি বগলদাবা করে ক্যাপ পরিহিত ওমর ফারুক সোজা দাঁড়িয়ে আছে। অনেকক্ষণ পর মুখ খুলেন হামিদ সাহেব।
– আপনি কী ওমর ফারুক?
এমডির এমন প্রশ্নের জন্য মোটেই প্রস্তুত ছিলো না ওমর ফারুক। মনে মনে ভেবেছিলো অন্যকোন জটিল প্রশ্ন করবে।
মৃদু কণ্ঠে ওমর বলে- জ্বি স্যার।
– হুম। পিএস ওয়ান, নাসরিন জাহানের রুমে জান, সে আপনাকে আপনার পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে সব বুঝিয়ে বলবে।
– ইয়েস স্যার বলে আবার স্যালুট দিয়ে তিন কদম পিছন দিকে গিয়ে টার্ন করে রুম হতে বেরিয়ে আসে। যতো পরিশ্রমই হোক না কেন ওমর ফারুক ভেতরে ভেতরে কোম্পানীকে ভালোবেসেছিলো। সে মনে মনে ভাবে চাকরিটা আর নেই। অনেক দুশ্চিন্তা মাথায় নিয়ে ওমর ফারুক পিএস ওয়ানের রুমে ঢোকে। পিএস ওয়ান একটি চিঠি ধরিয়ে দেয় ওমর ফারুকের হাতে। ঘণ্টাখানেক কথা বলে ওমর ফারুককে সব বুঝিয়ে দেয় পিএস সাহেব।
পড়ন্ত বিকেলের বৈকালিক হাওয়ায় ভাসছে সময়। চৌধুরী মঞ্জিলের গেটে আছড়ে পড়ছে ক্ষীণ আলোকছটা। ব্যাগ কাঁধে, গেটে এসে দাঁড়ায় ওমর ফারুক। কাগজ পত্র দেখাতেই দারোয়ন গেট খুলে দেয়। দারোয়ান নিচ তলার গাড়ির গ্যারেজের পাশেই ছোট্ট একটি রুম দেখিয়ে দিয়ে বলে- এই নাও, রুমের চাবি। আজ থেকে এটাই তোমার থাকার রুম। রুমটিতে ওমর ফারুক ঢুকতেই বদ্ধ রুমের এক পসলা ভ্যাপসা গন্ধ এসে নাকে মুখে লাগলো। কাঁধের ব্যাগটি নামিয়ে সমস্ত রুম পরিস্কার পরিছন্ন করে। সুবিধার দিক হলো, রুমের সাথেই রয়েছে এ্যাটাস্ট বাথ। বাথরুমে ঢুকে গোসল শেষে ফুরফুরা মেজাজে বেরিয়ে এলো ওমর ফারুক। ততক্ষণে বুয়া এসে টেবিলে নাস্তা আর চা দিয়ে গেছে। সন্ধ্যাকালীন নাস্তা শেষে পোষাক পড়ে বেরিয়ে পড়লো ডিউটির উদ্দেশ্যে। ওমর ফারুক স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে মনে মনে বললো- বিধাতা সবই তোমার লীলা খেলা। ফকিরকে বানাও বাদশা আর রাজাকে বানাও মিসকিন। বলাই বাহুল্য, নিরাপত্তা প্রহরীর পোষাকে ওমর ফারুককে ভিষণ হ্যান্ডসাম লাগে। মেইনগেটে হাজির হতেই সেখানকার নিরাপত্তা প্রহরী গেটের চাবি বুঝিয়ে দিয়ে বাড়তি কোন কথা না বলে সোজা তার রুমের দিকে পা বাড়ালেন। গেটের পাশেই একটি টোল রাখা আছে। সেখানে বসারও সু-ব্যবস্থা আছে। দীর্ঘসময় অলসভাবে পার করলো ওমর ফারুক। গেটে এসে কেউ নক করছে না এমন কী গেটের বাইরেও কেউ যাচ্ছে না। হঠাৎ একটি টেনিস বল এসে ওমর ফারুকের মাথায় লাগলো। বলটি মাথায় লেগেই সুয়িং করে গেটের সামনে গড়াগড়ি খাচ্ছে। অনেকক্ষণ বলের দিকে তাঁকিয়ে ভাবতে থাকলো, নি:ছিদ্র নিরাপত্তা এখানে বল কীভাবে এলো? চারপাশে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাঁকাতেই দেখতে পেলো, গাড়ির গ্যারেজের উম্মুক্ত পিলারের ফাঁকে যতোদুর চোখ যায় বিশাল আয়তনের ঘাস চাতালের মাঠ। মাঠের শেষ প্রান্তে আড়াআড়িভাবে ইউ আকৃতির অন্য আরেকটি বিল্ডিং। আজব ব্যপার এরকম ডিজাইনের বাড়ি ওমর ফারুক বাবার জীবনে দেখেনি। কম করে হলেও এক একর জমির উপর দুটি বাড়ি, একা একা দঁড়িয়ে আছে। হৈ চৈ করতে করতে দু’জন মেয়ে এসে ওমর ফারুকের ভাবনায় ছেদ ঘটালো। টাউজার, টি শার্ট, পায়ে কেটস্, মাথায় ক্যাপ পরিহিত মেয়ে দুটিকে দেখতে অপূর্ব সুন্দরী মনে হচ্ছে। দু’জনের চেহারা এবং বয়সে হুবহু মিল। দু’জনকে দেখে পৃথক করা কঠিন। আড় চোখে দু’জনকে দুর থেকে আসতে দেখে ওমর ফারুক গেটের দিকে মুখ ফিরিয়ে বসে রইলো। বড়লোকদের বিরাট কারবার। কী থেকে কখন কী হয়ে যায় তার শেষ নেই। প্রথম দিন করণীয় সম্পর্কে ভালোভাবে অকিবহাল নয় ওমর ফারুক। মেয়ে দুটি পেছনে এসে দঁড়ায়। ধমকের স্বরে বলে- তোমার কী হয়েছে আংকেল? অনেক সময় হয়ে গেল বলটি খেলার মাঠে পাঠালে না কেন? কাজে যদি মন না বসে তো চাকরি ছেড়ে চলে যাও। আগেতো এরকম ছিলে না। দাঁড়াও, আজকে বাপ্পীকে বলে তোমাকে ছাঁটাই করার ব্যবস্থা করছি। দাও, বলটা উঠিয়ে দাও। চাকরি হারানোর ভয়ে ক্ষীপ্ততার সাথে বলটা তুলতে যায় ওমর ফারুক। গেটের ফ্ল্যাটবারের সাথে ধাক্কা খেয়ে কিঞ্চিত কেটে যায়, পরে যায় মাথার ক্যাপ। কপাল কেটে রক্ত বেরিয়ে চোঁয়াল দিয়ে রক্ত গড়িয়ে পরে। কোনোদিকে খেয়াল নেই ওমর ফারুকের। বলটি তুলে মেয়েগুলোর হাতে তুলে দিয়ে দু’হাতজোড় করে ওমর বলে- “ম্যাডাম”, আমি আজ নতুন জয়েন করেছি, বল যে মাঠে গিয়ে দিয়ে আসতে হয় আমার জানা ছিলো না, আজ জানলাম। এরকম ভুল আমার জীবনেও হবে না। আমাকে ক্ষমা করে দিন। পেটে লাথি দিবেন না ম্যাডাম।
মেয়ে দুটি হামিদ সাহেবের যমজ কন্যা, আশা এবং দিশা। দু’বোন এক সাথে প্রাইভেট মেডিক্যাল কলেজের তৃতীয় বর্ষের ছাত্রী। এতোক্ষণ তম্ময় মথয় হয়ে ওমরের কথা শুনছিলো। অপলোক দৃষ্টিতে তাঁকিয়ে ছিলো ওমর ফারুকের কপাল চুঁইয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তের দিকে। হঠাৎ দু’বোন ফিস ফিস করে কী যেনো বলাবলি করে। এরপর গেটের মধ্যে বল ছুরে মেরে দৌড়ে ভেতরের দিকে চলে যায়। ওমর ফারুক কিংকর্তব্যবিমুঢ়। আশা আর দিশার গমন পথের দিকে অবাক নয়নে তাঁকিয়ে থাকে। এতোক্ষণেও টের পায়নি ওমর ফারুক তার গাল চুঁইয়ে রক্ত ঝরছে। সুখ হয়তো সবার কপালে সয় না। সকালের উজ্জ্বলদীপ্ত সূর্যটা খিলখিলিয়ে হেসে চুপিসারে বলেছিলো- ওমর ফারুক, তোর কপাল খুলেছে। আর সূর্যের তেজ কমে নিঃশ্বেস হওয়ায় রাতের অন্ধকার গিলে খেতে চাচ্ছে, সকল আশার প্রজ্জলিত শিখা। দুশ্চিন্তার ঘামে একাকার হতে থাকে ওমর ফারুকের ঝরেপড়া পরিশ্রান্ত তরতাজা রক্ত। উলট-পালট ভাবতে ভাবতেই মেইন গেটের বাইরে গাড়ির হর্ণ বেঁজে উঠলো। ক্ষিপ্তহস্তে গেইটের মেইন ফটক খুলে স্যালুট দিয়ে সটান দাঁড়িয়ে রইলো ওমর ফারুক। পাজারো গাড়িটি দেখেই অনুমান করলো, এটি স্যারের গাড়ি। গাড়ি গ্যারেজ করে জনাব হামিদ সাহেব সোজা গেটের সামনে চলে এলেন। সাথে দু’পাশে দু’জন গানম্যান, ভেতরের অন্তর আত্মা থর থর করে কাঁপতে থাকে। হঠাৎ করে স্যার এদিকে আসছে, নিশ্চয়ই মেয়ে দুটি অভিযোগ করেছে। দুশ্চিন্তায় হাটু কাঁপতে থাকে। হামিদ সাহেব এসে পাশে দাঁড়ায়। ওমর ফারুক কী হয়েছে তোমার? কোন সমস্যা?
– না স্যার, কোন সমস্য নেই।
– বললেই হলো? তোমার কপাল দিয়ে রক্ত বেরুচ্ছে কেন?
– কই, না তো স্যার, বলে কপালে হাত দেয় ওমর ফারুক। হাতের তালুর দিকে তাঁকিয়ে অবাক হয়। সত্যিইতো কপাল দিয়ে রক্ত বের হচ্ছে। এতক্ষণ টের পায়নি ওমর ফারুক।
রাগত কণ্ঠে হামিদ সাহেব বলেন- মনোযোগ সহকারে ডিউটি করতে গিয়ে কখন কপালে আঘাত পেয়েছো টের পাওনি। অর্থাৎ, নিজের প্রতি যদি এতো উদাসিন হও, তাহলে ধরে নিতে হবে আশে পাশে কী ঘটছে তাও জানো না। সবদিকেই খেয়াল রাখতে হবে। গেট তালা দিয়ে যাও হাত মুখ ধুয়ে এসো। পারলে হালিমকে ডেকে গেটে বসিয়ে ডাক্তার দেখিয়ে আসবে। হামিদ সাহেব তর তর করে ভেতরে প্রবেশ করলেন। ওমর ফারুক তার রুমে ঢুকে বাথরুমের আয়নার দিকে তাঁকিয়ে নিজের কাঁটা কপালটা একবার দেখে নিলো। দুই তিন বার পানি ছিঁটিয়ে মুখটা পরিস্কার করলো। না, কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। অবিরাম রক্ত বের হচ্ছে। হঠাৎ ভাবনার ছেদ ঘটিয়ে আশা আর দিশা এসে রুমের সামনে হাজির। ওমর ফারুক কিছু বুঝে উঠার আগেই প্রায় চ্যাংদুলা করে ওমর ফারুককে খাটের মধ্যে শুইয়ে দিয়ে ডাক্তারি বিদ্যা শুরু করলো। প্রথমে ডেটল দিয়ে পরিস্কার করলো ক্ষতস্থান। এরপর ড্রেসিং। না, তেমন একটা কাটেনি তাই সেলাই এর প্রয়োজন নেই। ব্যান্ডেজ করে ব্যাথানাশক ট্যাবলেট খাইয়ে দেয়া হলো। ক্ষিপ্ত গতিতে আশা আর দিশা চিকিৎসা শেষে রুম হতে বের হবার সময় বললো- এবার বেডরেষ্টে থাকুন। আমরা আংকেলকে ডেকে গেটে পাঠিয়ে দিচ্ছি, বলে ক্ষিপ্ততার সাথে রুম থেকে বেরিয়ে আসলো। একবুক দীর্ঘশ্বাস নিয়ে ওমর ফারুক মনে মনে বললো- এটাই হলো ধনি মানুষের খেয়ালিপনা। মানুষকে হাসাতেও সময় লাগে না, কাঁদাতেও না, আবার ইচ্ছে হলে আপন করে নিলো, পর ভেবে দুরে সড়িয়ে দিতেও কুণ্ঠিত নন এরা। উচ্চবিত্তদের মায়া, মমতা, স্নেহ ভালোবাসা আষাঢ়ের বৃষ্টির মতো, ইচ্ছে হলো অঝোর ধারায় ঝরছে আবার চোখের পলকেই উধাও। শরীরের ইউনিফর্ম না খুলেই ক্লান্তিতে ঘুমিয়ে পড়লো ওমর ফরুক।
রুমের দরজা লাগায়নি। রাতের ভাত টেবিলের উপর রাখা। তেলাপোকা গড়াগড়ি খাচ্ছে ভাত আর তরকারির উপর। খোলা দরজার ফাঁক গলিয়ে সূর্যের কিরণ রুমে ঢোকার কোন রাস্তা খুজে পায়নি। কিন্তু আশা আর দিশা ঠিকই ঢুকে পড়েছে রুমের ভেতর। দু’জনের শরীরে ডাক্তারি পোষাক। মেডিকেল কলেজে যাবে, যাবার ফাঁকে রোগির খোঁজটা নিয়ে যাবে ভেবেই এই অপ্রত্যাশিত আগমন। বিপত্তি হলো ওমর ঘুমে বেহুস। ওরা দু’জন কোনভাবেই স্থির করতে পারছে না কী ভাবে ওমর ফারুককে জাগাবে। হালকাভাবে কাশি দেয়, রুমের ভেতর শব্দ করে হাটাহাটি, উহু কিছুইতে কাজ হচ্ছে না। রাগে গদ গদ করতে থাকে আশা আর দিশা। একে অপরের মুখের দিকে তাঁকিয়ে ভাবের বিনিময় ঘটায়। ওদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সকালের হাতজোড় করার আকুতি মিনতী। অল্পতেই সুদর্শন হলেও চাকরিটা তার বড় বেশী প্রয়োজন। আশা ব্যাগ হাতরিয়ে এক টুকরো কাগজ বের করে সেখানে লিখে, আপনি ডিউটিরত অবস্থায় ইউনিফর্ম পড়ে বেলা নয়টা পর্যন্ত ঘুমানো রীতিমত দায়িত্বহীনতার পরিচয় দিয়েছেন, যা আমরা প্রত্যক্ষ করলাম। এমতাবস্থায় আপনাকে চাকরি হতে কেনো বরখাস্ত করা হবে না তার কারণ দর্শান। আশা ও দিশা টেবিলের উপর কাগজের টুকরো নামিয়ে রেখে রুম হতে বেরিয়ে আসে।
ওমর ফারুকের ঘুম ভাঙ্গে সকাল ১০ টায়। ধরপর করে বিছানায় উঠে বসে। সময়ের দিকে তাঁকিয়ে অবাক হয়। তরিঘরি করে গোসল শেষে পোষাক বদলে নেয়। হঠাৎ চোখ গিয়ে আটকে পরে টেবিলের উপর রাখা এক টুকরো কাগজের উপর। কাগজটি তিনবার পড়ে আর ভাবে। না, সে কোনো জুতসই উত্তর খুঁজে পায় না। সঙ্গে থাকা সামান্য কিছু কাপড় ব্যাগের মধ্যে ভরে সোজা রওয়ানা হয় বাড়ির উদ্দেশ্যে। এতোদিন চাকরি করে যা পেয়েছে সব টাকা নিয়ে বাবা এবং মায়ের হাতে দেয়। দিন যায় সপ্তাহ যায় মাস পেরিয়ে যায়।
বাবা অসুস্থ্য শরীর নিয়ে জিজ্ঞেস করে- চাকরিতে যাচ্ছিস না কেন? ওখানে কোন সমস্যা হয়েছে?
– না বাবা, এই তো যাবো।
চা এর দোকানে এখন পত্রিকা রাখে। প্রতিদিন পত্রিকার বিজ্ঞাপন পড়ে। AB+ রক্তের কিডনি জরুরী ভিত্তিতে প্রয়োজন। মুমূর্ষ রোগির প্রাণ বাঁচাতে কেউ স্বেচ্ছায় কিডনি দান করতে চাইলে নিম্নের ঠিকানায় যোগাযোগ করুন। ওমর নাম্বারটি লিখে নিরিবিলি জায়গায় দাঁড়িয়ে ফোন দেয়। অনেক কথা হবার পর পাঁচ লক্ষ টাকা দাম সাব্যস্ত হয়। আজই যেতে হবে। দৌঁড়ে বাড়ি এসে বাবা মাকে বলে- অফিস আমাকে দ্রুত ডেকেছে আজকেই ঢাকা যেতে হবে মা। মা-বাবা হাসি মুখে সন্তানকে বিদায় জানায়। রাত ৮ টায় এ্যপোলো হাসপাতালের গেটে এসে হাজির হয় ওমর ফারুক। গেটে দাঁড়িয়ে ফোন করল, একজন বৃদ্ধ বয়সের লোক এসে তাকে ক্যাবিনে নিয়ে যায়। ক্যাবিনের সিটে বসে পা দোলাচ্ছে আশা। ওমর ফারুক ক্যাবিনে ঢুকেই কিংকর্তব্যবিমুঢ়। এখানে আশা এলো কোথা থেকে? ওমর ফারুক ক্যাবিনের এক কোণে জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। নিজেকে যতোই লুকাবার চেষ্টা করুক কিন্তু আশার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি এড়াতে পারে না ওমর ফারুক। আশা ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়ায়, বৃদ্ধ এক লোককে উদ্দেশ্য করে বলে- আংকেল কিডনি ডোনারের সাথে আমি একটু কথা বলতে চাই। হ্যাঁ সূচক মাথা দুলাতেই আশা এসে উপস্থিত সবার সামনে হাত ধরে ওমর ফারুককে কেবিন থেকে টেনে বের করে নিচ তলার বেড রুমে গিয়ে বসে। দু’জন সামনা সামনি বসে জিজ্ঞেস করে আশা- কেমন আছো ওমর?
ওমর আশার চোখের দিকে না তাঁকিয়ে অন্যদিকে মুখ ফিরিয়ে বলে- ভালো।
– তুমি কাউকে কিছু না বলে চোরের মতো পালিয়ে গেলে ক্যান। চোর শব্দটি শুনা মাত্র ওমর ফারুকের ভেতরে ছ্যাত করে উঠে। কোন কথা বলে না। আশা আবার বলতে থাকে, বাবা তোমার নামে থানায় মামলা করেছে। তুমি মালামাল নিয়ে বাসা হতে পালিয়ে গেছো। ভালোই হলো, পুলিশ ধরে আনার আগেই তোমার সাথে আমার দেখা হলো। এখন বলো- পুলিশে ধরিয়ে দিলেই তুমি খুশি হবে না কিডনি বিক্রি করে টাকা নিয়ে বৃদ্ধ বাবা মায়ের হাতে তুলে দিলে খুশি হবে? তবে আমরা ভাবতেই পরিনি সামান্যে দু’কলম লেখায় তুমি পালিয়ে যাবে? যাক সেসব কথা, এখন বলো- আমি তোমার জন্য কী করতে পারি? ততক্ষণে মেসিয়ার দু’কাপ ধুমায়িত কফি দিয়ে গেছে। আশা অবলিলায় পান করছে। ওমর ধুমায়িত কফির দিকে অপলকভাবে তাঁকিয়ে রাজ্যের চিন্তা করছে। অনেক ভেবে চিন্তে মাথা চুলকিয়ে ওমর ফারুক বলে- ঠিক আছে, ম্যাডাম আমি যেহেতু আপনাদের দৃষ্টিতে অপরাধী সেহেতু আমাকে পুলিশে দেয়াই ভালো।
– ও বুঝতে পেরেছি, কিডনি বিক্রি করতে এখন ভয় পাচ্ছো? গরীব মানুষ, পেটের দায়ে কখন যে কী করে আর কখন যে কী ভাবে তা বুঝে উঠা কঠিন। এখন রোগিটির কী হবে? একবার ভেবে দেখেছো? মাথায় বেশ কয়েকটি চুল টেনে টেনে ছিড়ে ফেলে ওমর ফারুক। আর সেই চুলগুলো ভাসতে থাকে কফির পেয়ালায়। ওমর ফারুক বলে- ম্যাডাম, আমাকে নিয়ে যেহেতু এতো সমস্যা তাহলে আগে কিডনিটা দেই তারপর পুলিশে দিয়ে দিয়েন। তাহলে দুটো বিষয়েরই সমাধান হয়ে যাবে।
আশা হাতে তুড়ি মেরে বলে- গুড আইডিয়া। এটা চমৎকার সমাধান। এটাতো তোমার প্রস্তাব কিন্তু আমার একটি প্রস্তাব আছে।
– বলুন
– তুমি কিডনি বিক্রির ব্যপারে পাঁচ লক্ষ টাকা দাম সাব্যস্থ করেছিলে। তোমাকে ফ্রি কিডনি ডোনেট করতে হবে।
– ঠিক আছে ম্যাডাম। আপনাদের নুন খেয়েছি, তাই আপনাদের সকল আদেশ আমার শিরোধার্য। আমরা কৃতদাশ। বংশ পরমপরায় হতদরিদ্র। কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছেন “হে দরিদ্র তুমি আমাকে করেছো মহান” আমার বেলায় ঘটেছে উল্টো, দারিদ্রতা আমাকে ভৃত্য বানিয়ে ছেড়েছে। কথগুলো আবেগতাড়িত হয়ে একদমে বলে ফেললো ওমর ফারুক। বুকের ভেতর জমে থাকা বরফখন্ড গলে পানি হয়ে অঝোড় ধারায় গড়িয়ে পড়ছে। খুব মনোযোগ সহকারে ওমর ফারুকের দিকে তাঁকিয়ে আছে আশা। অনেক সময় পর মুখ খুললো সে- শোনো ওমর ফারুক, আমি যা বলবো, তুমি শুধু হ্যাঁ বা না বলবে। ঠিক আছে?
– ওকে ম্যাডাম।
দু’জন গিয়ে হাজির হলো রোগির ক্যাবিনের সামনে। এরপর বৃদ্ধ বয়সী সাদা পাকা চুল ওয়ালা এক ভদ্র লোককে ডেকে বললো- শুনুন আংকেল, এই ছেলেটি গ্রামের সহজ সরল মানুষ ওর রক্তের গ্রুপ O+ অর্থ্যাৎ AB+ পজেটিভ এর ব্যবধান বুঝতে পারেনি। তাই ওর কিডনিটি আমাদের কোন কাজে আসবে না। অন্য আরেকজন আসার কথা আছে অগত্যা তারটাই নিতে হবে।

আশা আংকেলকে সালাম দিয়ে উমরকে নিচে আসার ইঙ্গিত করে। উমর ও আশাকে ফলো করতে থাকে। আশা ওমরকে গাড়িতে উঠতে বললে উমর পাকা রাস্তার দিকে হাঁটতে থাকে। উপায় অন্ত না পেয়ে আশা পেছন পেছন দৌড়ে এসে উমরকে জাপটে ধরে। টেনে হিচড়ে এনে প্রাইভেটে বসায়।
এরপর ওমরকে নিয়ে যায় আশাদের বাসায়। এসির মধ্যে বসে থেকেও দরদর করে ঘামছে ওমর। মনে মনে দোয়া দরুদ পড়তে থাকে। না জানি কী আছে কপালে আল্লাহ মালুম।
হামিদ সাহেব উমরকে দেখে চেয়ার থেকে লাফিয়ে ওঠে। একবার আশার মুখের দিকে তাকায় আবার ওমরের মুখের দিকে তাকায়।
আশা বলে- শোনো বাবা, তোমাকে আগেই বলেছি আমি আর দিশা মিলে ওকে বাসা হতে তাড়িয়ে দিয়েছি। তুমি বলেছিলে, তোমারা দু’বোন মিলে ওকে তাড়িয়েছো তোমরাই ওকে খুঁজে বের করবে। তাই আজ হাতে নাতে ধরে তোমার কাছে নিয়ে এসেছি।
হামিদ সাহেব হালকা পায়চারী করে, টাই এর নফটা নারাচারা করতে করতে বলেন- হুম। আমার মাথায় ঢুকছে না, উমর আমাদের কোম্পানীর নিকট এক মাসের বেতন পাওনা রেখে এভাবে কাউকে না বলে চলে যেতে পারে? যাবার সময় ইচ্ছে করলে কতোকিছু নিয়ে যেতে পারতো কিন্তু কিছুই নেয়নি? ইভেন আমাকে ঋণি রেখে চলে গেছে। এই নির্মম সমাজ ব্যবস্থা এরকম নীতিবান, কর্মঠ, সৎ, পরিশ্রমী, নিরাপত্তা প্রহরীর বড় বেশি অভাবের মা। যাও, যেভাবে পারো ওর অভিমান ভাঙ্গিয়ে ওকে আবার চাকরিটা ফিরিয়ে দাও। ওর যোগ্যতাই একদিন ওকে অনেক দূর নিয়ে যাবে।
বাবার আদেশ পেয়ে আশা ওমরকে নিয়ে তার রুমের দিকে রওনা হয়। ওমরও সতস্ফূর্তভাবে পুনরায় কাজে যোগদান করে। ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে আশা ও দিশার খেলার সাথী। গভীর রাতে আশা ও দিশা স্বপ্ন দেখে ওরা দু’বোন ঝগড়া করছে, মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে ওমর। আকাশের দিকে তাকিয়ে ওমর বিড়বিড় করে কী যেনো বলতে থাকে। একঝাঁক দমকা হাওয়া উড়িয়ে নেয় তার মুখের কথা।

- Advertisement -

 

আলোকিত প্রতিদিন/৩০ জুলাই’২০/এসএএইচ

- Advertisement -
- Advertisement -