নূরুজ্জামান: শিল্প-সংস্কৃতির বিভিন্ন ঘাট মাড়িয়ে জ্ঞান ও বোধে সমৃদ্ধ হয়ে ওঠা সৈয়দ রনো’র ‘বৃষ্টিমাখা রোদ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতাগুলো ঐতিহ্যের পোড়ামাটি থেকে নির্যাস নিয়ে এঁকেবেঁকে চলেছে সমকালিন সমাজবাস্তবতার নিষ্ঠুর রেখচিত্র,রাজনৈতিক স্খলনের নির্মম কষাঘাত,বৈজ্ঞানিক সম্ভাবনা ও ধর্মীয় বিশ্বাসের বৈচিত্র নিয়ে। উচ্চাভিলাসী স্বপ্নদ্রষ্টা কবির বিচিত্র ভাবনাগুলো নিয়ত বিবর্তনশীল বিশ্বজগতের গ্রহ-নক্ষত্রের মতো বৈচিত্রময় বিবর্তনশীল হয়ে ধরা দিয়েছে ‘বৃষ্টিমাখা রোদ’ গ্রন্থে।সেই বৈচিত্রের রহস্য ভেদ করে তাঁকে বৈজ্ঞানিক যন্ত্রে অনুসন্ধান করে নিত্য নতুন রূপে খুঁজে অত্যাধুনিক শিল্পবোদ্ধারা,
‘কাব্যিক চিত্রকল্পে সাজাই
আকাশ বসতি
ইউরেনাস নেপচুন প্লেটোর
ধর্মযাজক আমি
প্রতিনিয়ত নাসা’র বিজ্ঞানীরা
মেরামত করে আমার চিন্তার জগত’ (কাব্যকলায় বিজ্ঞান)।
আবার পারস্যের সুফী কবি হাফিজের সাকি-শরাবের লিলাকীর্তনকে ভিন্ন মাত্রায় ধরতে দেখি ‘রুবাইয়াতে আকুতি’ কাব্যে- ‘শেষ বিকেলে সাকি-শরাব
আনন্দ সুখ কিচ্ছু নাই
খোদার শানে ধন্য হলো
জলসা ঘরের তুচ্ছ বাঁঈ—’
জীবনসায়াহ্নে এসে মানুষের জৈবিক প্রেম যখন সুখ দিতে ব্যর্থ হয়, তখন সে আধ্যাত্মিক আরাধনায় শান্তি খোঁজে।খোদার প্রেমে আত্মনিবেদন করে তখন তুচ্ছ বাঁঈজিও তুষ্ট হন।কারণ মহাপাপী বাঁঈজিও জানেন যে সৃষ্টিকর্তা মৃত্যুর আগ মুহূর্ত পর্যন্ত তার সৃষ্টির দিকে ক্ষমা ও নৈকট্যের হাত বাড়িয়ে দেন।তাই শরীয়তের মূল চেতনাকে ছাপিয়ে কবির ভাবনা এখানে হাফিজের প্রেমময় শ্রষ্টায় সমর্পণ করে প্রশান্তি পেয়েছে।এখানে কবির ধর্মবিশ্বাস ইসলামের শরীয়তের শরীর ঘেঁষে মারিফতে প্রবেশের চেষ্টায় নিবিষ্ট হতে দেখি। আধ্যাত্মিক জগতে পরিভ্রমণে সচেষ্ট কবি কিন্তু সমকালিন ধনতান্ত্রিক রাজনৈতিক দৈন্যতাকে ভুলে যান নি।রাজনৈতিক শোষণে বিভক্ত সমাজের নিম্নবিত্তের টিকে থাকার লড়াই ধরা পড়েছে ‘ভাতের খোঁজে লাশ’ কবিতায়,
‘নুন আনতে পান্তা ফুরায়
ভাতের খোঁজে লাশ
রাজনীতিতে ধরছে পচন
বললে কথা নাশ।’
ধনতান্ত্রিক রাজনীতির বৈষম্যের শিকার মেহনতি মানুষ যখন অধিকার আদায়ের লড়াই করতে যায় তখন দেশে দেশের স্বৈরতান্ত্রিক হয়ে ওঠা সরকারগুলো মিছিলে চালায় বুলেট,গলা টিপে ধরে বাকস্বাধীনতার।গণতন্ত্রের আড়ালে নিভৃতে বেড়ে উঠা স্বৈরতান্ত্রিক সমাজের এই করুণ চিত্র মনে করিয়ে দেয় অন্নদা শঙ্কর রায়ের দেওয়া বীরত্বের সংজ্ঞাকে।তিনি বলেছেন,”বীরত্ব হল দুর্বলের ওপর সবলের অত্যাচার”।শ্রেণিবিভক্ত সমাজের কান্না দেখেও রাষ্ট্র যেন না দেখার ভান করে নিশ্চিন্তে নাকে তেল দিয়ে ঘুমায়। তেমনই বৈষম্যের শিকার রাজনৈতিক সমাজের শোষক আর শোষিতের দিনপুঞ্জি ধরা পড়েছে নিম্নের স্তবকে,
‘খাট ছাড়াই শ্রমিক ঘুমায়
কৃষক ঘুমায় মাঠে
শোষক যারা সুখেই আছে
রাষ্ট্র ঘুমায় খাটে।'(ভাতের খোঁজে লাশ)।
নিপিড়ীত মানুষের কষ্টের পাহাড়ে গেঁথে আছে কান্নার জল।সেই কান্নার ঝর্ণাকে পাথর চাপা দিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত সংসার ধর্মের জালে বন্দি অভাবি মানুষকে মিথ্যে ভালোবাসা ও সুখের চাতুর্যের ছলনা করতে হয়।
‘নিশি দিন কতো ঋণ
কাঁদে কতো লোক
ছলনার গান ধরে
কামনার শোক।’ (ভাবের পদাবলী)।
শত অভাব অভিযোগের মধ্যেও মায়ার বাঁধনে বন্দি জীবনে প্রেম আসে স্বর্গীয় সুখ নিয়ে।কখনো বা সেই সুখে থাকে মধুর খুনসুটি,বাদবিবাদ।আবার কখনো বা সেই প্রেমই বিরহের আগুন পুড়িয়ে খাক করে।এসবই সমাজবদ্ধ জীবনের চিরকালীন বৈচিত্র।সেই মায়ার বাঁধনে জড়ানো স্বর্গীয় সুখ ও বিরহের ফাঁদে কাঁদা সমাচিত্র উঠে এসেছে ‘ভাবের পদাবলী’র অন্য স্তবকে- ‘মায়ার বাঁধনে প্রেম
স্বর্গের সুখ
বিরহের জ্বালায় কাঁদে
অভাগার বুক।’
কাব্যের কবিতাগুলো কখনও ভাবছন্দে,কখনো স্বরবৃত্ত ও মাত্রাবৃত্তের হাত ধরে নাচতে নাচতে গতিময় বৈশিষ্ট্য ধারণ করে মানুষের সমকালীন ও ভবিষ্যত ভাবনার ছবি এঁকেছে।কবিতার বৈশিষ্ট্যে আছে নর্তকীর নৃত্যের ঝংকার,আছে গ্রামের মেঠোপথ ধরে কলশি কাঁখে কোমর দুলিয়ে ছুটে চলা কিশোরীর ঢং,আছে ধানের আইল ধরে হেঁটে চলা কৃষাণীর বাতাসে উড়া শাড়ির রঙিন আঁচল।এমন বিচিত্র শৈল্পিক বাঁক ধরে সৈয়দ রনোর কবিতা ছুটে চলেছে কৃষক-শ্রমিকের নিরন্ন কঠিন কঠোর শরীর ও জীর্ণ কুঠির থেকে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের অতল রহস্যে।তাই তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে রবি ঠাকুরের কবিতার শৃংখলমুক্তির অভিপ্রায়ে প্রদত্ত ’কবিতা এখন স্বর্গে গেলেও সঙ্গের কুকুরটিকেও ছাড়ে না” বক্তব্যের নিগুঢ় সত্যের সন্ধান মিলে।‘বৃষ্টিমাখা রোদ’কাব্যের কবিতাগুলোও তার ব্যতিক্রম নয়।
আলোকিত প্রতিদিন/৩০ জুন ‘২০/এসএএইচ