আজ বৃহস্পতিবার, ২৫ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।   ১০ অক্টোবর ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

আকলিমা আক্তার রাইসা’র গল্প ‘চন্দ্রার বিয়ে’

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

চন্দ্রার বিয়ে
আকলিমা আক্তার রাইসা
:::::::::::::::::::::::::::::

ষাট হাজার টাকা। হ্যাঁ, শেষ অবধি ষাট হাজার টাকাতেই ঠিক করা হয়েছিল চন্দ্রার বিয়ে। দরিদ্র্য পিতা মকবুলের এর বেশি সামর্থ্য নেই।
তিন মেয়ে আর রোগাক্রান্ত স্ত্রী নিয়ে কায়ক্লেশের সংসার মকবুলের। সম্পত্তির মধ্যে ভিটে বাড়িটুকুই। পরিবারের জীবিকা নির্বাহের বড় মাধ্যম তার পুরাতন রিক্সাটা। রিক্সাটা পুরাতন হলেও মকবুলের পায়ের জোরে বেশ হনহনিয়েই চলে। স্ত্রী করিমন পাশের মাতব্বর বাড়িতে ঝিয়ের কাজ করে। তিন মেয়ের মধ্যে চন্দ্রাই বড়। বয়স সতেরোর কাছাকাছি। বাকি একটার বয়স নয়, আরেকটার বয়স দুই।
মোটামুটি চলে যাচ্ছিলো মকবুলের সংসার। হঠাৎই করোনা নামের এক বিশ্বমহামারী হানা দিলো দেশে। তছনছ হয়ে যেতে থাকলো জীবন। ভেঙে যেতে থাকলো অর্থনীতির কাঁটা। ক্রমশ নুয়ে পড়তে থাকলো মকবুলের সংসার। পুরো এলাকা লকডাউন। রিক্সা নিয়ে বাইরে বের হবার জোঁ নেই। করিমনকেও কাজে যেতে নিষেধ করে দিয়েছে মাতব্বর বাড়ির কর্তাবউ।
চন্দ্রার সেই হাসি হাসি মুখ এখন আর নেই, সেখানে শুধুই বিষাদের ছায়া। জমানো কিছু চাল আর হাঁড়ির ভাত যেদিন সম্পূর্ণ শেষ হলো সেদিন আকাশও যেন রেগেমেগে একাকার। আর সেই রাগে মেঘেরা কেঁদেকেটে খুন। ভাঙা চালের বারান্দা সেই কান্নায় ভিজে যাচ্ছে। চন্দ্রার চোখের এক কোণেও জল ছলছল। একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে যেন কোনদিন ও বৃষ্টি দেখেনি।
করিমন আর মকবুল দুই মেয়েকে নিয়ে বসে আছে বারান্দার আরেক কোণে; এই দুজনই যেন অন্য কোন গ্রহের বাসিন্দা, এ পৃথিবী যেন বড্ড অচেনা তাদের চোখে; এমন এক অসহায় দৃষ্টি নিয়ে বৃষ্টির দিকেই তাকিয়ে আছে তারা।
ঝড়ের আশঙ্কায় মা পাখি যেমন করে ডানা দিয়ে আগলে রাখে ছানা পাখিগুলোকে, ঠিক তেমনি করে নিরীহ পাখির মতো মকবুল ও করিমন মেয়েদুটোকে নিয়ে গুটিসুটি হয়ে বসে আছে। হঠাৎ ভীষণ বজ্রপাত হলো, মকবুলের মনে হলো- তার মাথাতেই যেন আকাশটা ভেঙে পড়লো।
সন্ধ্যার দিকে মেঘের কান্না থামলো। সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত নেমে এলো পৃথিবীতে, কিন্তু সে রাতের সমস্ত কালো যেন আশ্রয় নিয়েছিলো মকবুলের ছোট্ট ঘরটায়। সে-রাতে হঠাৎই করিমনের ভীষণ জ্বর। ঘরে থাকার মধ্যে ছিলো দুটো কলা, যা চন্দ্রার দুই বোন খেয়ে নিয়েছে।
চন্দ্রার শুকনো মলীন মুখ দেখে মকবুল বেদনার্ত কন্ঠে বলল, ‘ও চন্দ্রা, আয় মা, আইজ আমরা পেট ভইরা পানি খায়া লই, কাইল চেয়ারম্যানের পোলা চাইল, ডাইল, আলু আর কী কী জানি দিবো কইছিলো। কাইল পাতিল ভইরা ভাত রান্দিবি। আর হুইকন্যা মইচ দিয়া আলু বরতা করবি, পেট বইরা খামু বেহেই।’
যথারীতি সকাল হলো। মকবুল চেয়ারম্যানের বাড়ির সামনে গিয়ে দেখে মস্তবড় লাইন। ভিড় ঠেলে নিজের জন্য খানিকটা জায়গা করে নিলো মকবুল। প্রায় দুই ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার পর আসলো ত্রাণ নেবার পালা। প্রথমত চাল, ডাল, আলু, তেল এসবের প্যাকেট দেখে মকবুল যেন স্বস্তি খুঁজে পেলো। মনে মনে ভাবলো, আজ পেট ভরে খেতে পারবে পরিবার নিয়ে। কিন্তু তার স্বস্তি অস্বস্তিতে রূপ নিলো খানিক পরেই। চারিদিক দিয়ে ক্যামেরাবন্দি করায় ব্যস্ত চেয়ারম্যানের চামচাটাইপের লোকজন । দশটাহাত মিলে তুলে দিচ্ছে প্যাকেট; মকবুল জীর্ণ হাত পেতে আছে দশটা হাতের কাছে। হঠাৎ যেন মকবুলের সামনে ভেসে উঠলো জীবনের নির্মম ভয়াল মূর্তি! রিক্সা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করলেও সে কোনদিন হাত পাতেনি কারো কাছে। আজই প্রথম। হাত বাড়িয়েছে, আর তা কালের কঙ্কালের মতো বন্দি হচ্ছে ক্যামেরায়। কর্কশ কণ্ঠের এক ধমকে মকবুলের চেতনা ফিরে এল,‘ঠিক কইরা দাঁড়া মকবুল, মুখটা এমন ভাব কইরা রাখলে কি ফডু সুন্দর অইবো, মুখে একটু হাসি লাগা; একটু হাসি মাইরা হাতটা বাড়া।’
মকবুলের মনে হলো এই যেন জীবনের চূড়ান্ত উপহাস। চেষ্টা করেও মকবুল যখন হাসতে পারছিল না, তখন আরেক ধমকে মকবুলের সামনের দুইটা দাঁত যেন আপনাআপনিই বেরিয়ে এলো।
দুপুরের দিকে মকবুল দুহাত ভরে বাজার নিয়ে আসছিল বাড়ির দিকে; কাছাকাছি আসতেই শুনলো কানফাটা কান্নার শব্দ। মকবুলের ছোট দুই মেয়ে মেঝেতে গড়াগড়ি করে কান্না করছে। ক্ষিদের যন্ত্রণায় কুঁকড়ে উঠেছে যেনো।
মকবুল ঘরে ঢুকলো। করিমন অচেতন হয়ে পড়ে আছে। কপালে হাত দিয়ে মকবুল জ্বর আন্দাজ করলো। গরমে কপাল টগবগ করছে। বুঝতেই পারা যায়- ঘিলু সিদ্ধ হয়ে আছে।
এমন সময় চন্দ্রা হাতে একটা রুই মাছ নিয়ে হাসিহাসি মুখ করে বাড়ি ফিরল। বাপকে দেখেই উৎসাহ নিয়ে দৌড়ে এলো। ‘বাজান, মাতব্বরের পোলায় এই মাছটা দিলো। কত্ত বড় মাছ দেহো। মায় তো কামে যাইবার পারে না, সেইজইন্যে খবর পাঠাইছিলো। আমি গিয়া দেহি মাতব্বরের ছুডু পোলাডা বিদেশ থাইক্যা আইছে, কত্ত খাওন রান্ধিছে চাচি, যদি দেখতা!’, একদমে যেন কথা শেষ করে চন্দ্রা।
মকবুল জিজ্ঞেস করলো ‘বিদেশ থেইক্যা তো দ্যাশে আওন না কইরা দিছে সরকার, হের বাড়ির মাইনষে কিছু কয় না?’
চন্দ্রা উত্তর দেয়, ‘মাতব্বরের পোলা যে গেরামে আইছে মাইনষে এত জানেও না, আর হে তো ঘরেই থাহে, আমারে চাচি কইছে মায়ের বদল আমি যেন যায়া কাম কইরা দেই একবেলা।’
মকবুল চুপ করে থাকে, অচেতন অবস্থায় পড়ে থাকা করিমনের দিকে একবার তাকিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলে, ‘হ, তাই যাইস।’
এভাবেই চলতে থাকে মকবুলের সংসার। এদিকে করোনার প্রকোপ বাড়তেই থাকে দেশজুড়ে। একদিন মকবুল পেটের তাড়নায় রিক্সাটা নিয়ে বাইরে গেল লকডাউন উপেক্ষা করে; একটা যাত্রীও পেয়েছিলো। চৌরাস্তার মোড়েই নামবে, বিশ টাকা ভাড়া। মকবুল চারিদিক মনোযোগের সাথে চোখ বুলিয়ে নিলো। তারপর রিক্সায় প্যাডেল ঘোরাতে শুরু করলো। কিছুদূর যেতেই রাস্তা অবরোধ করে দাঁড়ালো কয়েকটা ছেলে, বয়স চব্বিশ কি পঁচিশের। ছেলেগুলো এসেই বলতে শুরু করলো, ‘এই রিক্সা দাঁড়ান, আপনারা কি মানুষ হবেন না, দেশের এই পরিস্থিতিতেও আপনারা রিক্সা নিয়ে রাস্তায় আসেন কি করে?’
‘বাবারা, ঘরে খাওন নাই, পেটের জ্বালায় আস্তায় বাইরইছিগো বাজান’; এসব বলে অসহায় মকবুল তার দারিদ্র্যের প্রতিচ্ছবি উন্মোচন করতে যাচ্ছিলো। এমন সময় কোথা থেকে যেন এক মাঝবয়েসী নেতাগোছোর লোক আসলো। এসেই শুরু করে দিলো, ‘এই কুত্তার বাচ্চাদের এমনে বললে হবে না, নিজেরাও মরবে, আমাদেরও মারবে।’
শেষ অবধি মকবুলকে কান ধরে উঠবস করালো সেই লোকটি। মকবুলের পাথর হয়ে যাওয়া চোখে সেদিন বৃষ্টি নেমেছিল সবার অলক্ষ্যে।
শুক্রবার। এইদিনই চন্দ্রার বিয়ে ঠিক ছিলো। আকস্মিক মহামারী যেন সব উলটপালট করে দিয়েছে। লকডাউনে বিয়ে নিষেধ। তাছাড়া যেখানে জীবনযাপন করাই কষ্টসাধ্য সেখানে বিয়ে তো স্বপ্নের মতো।
সকাল থেকেই চন্দ্রার মনটা বিষণ্ন। মুখ ভার করেই কাজ করতে গেলো মাতব্বরের বাড়ি। সতর্কতার সাথেই যেতে হয় কাজে। লকডাউনে কারো বাড়ি যাওয়াও নিষেধ। কিন্তু মাতব্বর বাড়ির ছেলে দেশে আসছে বলে কথা। এতসব রান্নাবান্না তো মাতব্বরের বউ একা করতে পারে না, বাধ্য হয়েই ডাকা হয় তাকে।
সেদিন সারাদিন রান্নাবান্না, ধোয়ামোছার কাজ শেষে সন্ধ্যায় যখন চন্দ্রা বাড়ি ফেরার জন্য গুছিয়ে নিচ্ছিলো। আঁধ সের চাল আর দুইটা আলু নিলো সাথে। এমন সময় মাতব্বরের বউ কাশতে কাশতে ডেকে বললো, ‘ওরে চন্দা, চা-ডা লইয়া দিয়ায় তর ছোডোভাইজানের ঘরে। পোলাড়ার কয়দিন দইরা কাশি অইছে, শইলডায় জ্বর, জ্বর, গলায় ও নাকি দুক্কু পায়।’
‘আইচ্ছা চাচি, দিতাছি’ বলে চন্দ্রা হাতের চাল আর আলু উঠোনের একপাশে রেখে চা নিয়ে গেলো মাতব্বরের বিদেশফেরত ছোটছেলের ঘরে।
‘ভাইজান, আফনের চা’ বলে হাত বাড়িয়ে কাপটা দিতেই মাতব্বরের ছেলে রমেজ তার হাত ধরে ফেললো। অদ্ভুত এক উত্তেজনা চোখেমুখে ফুটে উঠেছিল রমেজের। উত্তেজনা লুকিয়ে বেশ হাসিহাসি মুখ করে বললো, ‘যা,দরজাটা দিয়া আয় চন্দ্রা, তর লগে গল্প করি, বিদেশ যে কত কি আছে!’
চন্দ্রা নিতান্ত সহজ ভাবেই উত্তর দিলো, ‘বাজান কইছে সইন্দার আগে বাইত যাইবার, বইন দুইডা মনে অয় আমার লাইগা কানতাছে, দুফুর তিগা খাওন ও পায় নাই।’
‘আরে কিছু হইবো না, বয়’, বলে রমেজ নিজেই বিছানা ছেড়ে উঠে দরজা বন্ধ করে। ঘণ্টাখানেক পর চন্দ্রা বাইরে আসে। ততক্ষণে আকাশে পূর্ণচন্দ্রের আলো। চন্দ্রার সারা শরীর জুড়ে অদ্ভুত লাল লাল ছোপ, যেন এক বন্য দারিদ্র্যেরই প্রচারণা।
উঠোন থেকে চাল আর আলু নিয়ে চন্দ্রা বাড়ির দিকে রওনা দিলো পূর্ণচন্দ্রের আলোয়। এই চাঁদের আলো যেন উপহাস করে যাচ্ছে চন্দ্রার গালে, গলায় এবং শরীরে লাল লাল আঁচড়ের দাগে।
চন্দ্রার কটিদেশ যেন এক ভয়ানক জড়তায় আচ্ছন্ন হয়ে আছে। চন্দ্রা আনমনে পা টলিয়ে টলিয়ে হাঁটতে লাগলো শরীরে মৃত্যুর বীজ নিয়ে। হঠাৎ আকাশের দিকে তাকিয়ে মনে মনে কী যেন ভাবতে লাগলো। তার মুখ থেকে মোহাবিষ্টের মতো বাক্য নির্গত হলো-
‘আইজ শুক্রবার, আমার বিয়া!’
একগুচ্ছ মেঘ কোথা থেকে যেন হঠাৎ এসে চাঁদটাকে আড়াল করে দিলো!

:::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::::
লেখক :
শিক্ষার্থী, বাংলা ভাষা ও সাহিত্য বিভাগ,
জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়,
ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।

- Advertisement -
- Advertisement -