গাজীপুরে খুলেছে ৫ শতাধিক পোশাক কারখানা, হয়েছে বিক্ষোভ, সবখানে কি মানা হচ্ছে স্বাস্থ্যবিধি!

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

:: প্রতিনিধি, গাজীপুর::
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে জেলাজুড়ে দেওয়া লকডাউনের মধ্যেই গাজীপুরে চালু হয়েছে পাঁচ শতাধিক পোশাক কারখানা। পোশাক কারখানার মালিকদের পক্ষ থেকে আজ রোববার (২৬ এপ্রিল) কারখানার আশেপাশে অবস্থান করা শ্রমিকদের কাজে যোগ দেওয়ার প্রকাশ্যে ঘোষণা দেওয়া হয়েছিল। তবে বাস্তবে দেখা গেছে, কাজে যোগ দিতে ছুটে এসেছেন সরকার ঘোষিত ছুটির কারণে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে যাওয়া শ্রমিকরাও। এদিন প্রতিটি কারখানায় সরকার ঘোষিত স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের স্বাস্থ্য পরীক্ষা ও হাতধোয়ার ব্যবস্থা করা হয়। বেশিরভাগ কারখানা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, ভেতরে সামাজিক সুরক্ষা মেনে শ্রমিকদের প্রবেশ করিয়ে কাজ করানো হয়েছে। তবে গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে দেওয়া হয়নি। এদিকে কারখানা শ্রমিকদের মধ্যে রয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। তারা বলছেন, টেবিলে লোক কমানো হলেও সামাজিক দলগত কাজে সামাজিত দূরত্ব বজায় রাখা অনেকটাই দুঃসাধ্য। অন্যদিকে শ্রমিক কমিয়ে আনার কারণে অনেকেই হয়েছেন চাকুরিচ্যুত বলেও রয়েছে অভিযোগ। এনিয়ে বিক্ষোভ করতেও দেখা গিয়েছে।
সরেজমিন বেশ কয়েকটি পোশাক কারখানা ঘুরে দেখা গেছে, সেখানে শ্রমিক পৌঁছানোর পরে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করে ও প্রত্যেককে মাস্ক পরিয়ে কারখানার প্রবেশ গেটে আনা হচ্ছে। সেখানে অনেক প্রতিষ্ঠান আগেই পাত্রভর্তি জীবানুনাশক পানি রেখে দিয়েছে। শ্রমিকরা সে পানিতে নিজের পা ও জুতা চুবিয়ে পরিষ্কার করে যাচ্ছেন নিরাপত্তা কর্মীর কাছে। তিনি থার্মাল স্ক্যানার দিয়ে পোশাক কর্মীদের তাপমাত্র মাপার পর তাদের ভেতরে প্রবেশ করতে দিচ্ছেন। এরপরেই ভেতরে কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান বেসিনে আবার কোনও কোনও প্রতিষ্ঠান সাপ্লাই পানির লাইনে একাধিক ট্যাপ লাগিয়ে ও সাবার রেখে শ্রমিকদের হাত-মুখ ধোয়ার ব্যবস্থা করেছে। এরপরই তারা কাজের জন্য কারখানার ভেতরে প্রবেশ করছে। তবে কাজের জায়গাটিতে কতটা সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে সে তথ্য পোশাক কারাখানাগুলো গণমাধ্যমকর্মীদের ভেতরে প্রবেশ করতে না দেওয়ায় দেখা যায়নি। তবে কারখানাগুলো দাবি করেছে সেখানে সামাজিক দূরত্ব মেনে ফঁকা ফাঁকা বসে কাজ করেছে শ্রমিকরা। যেহেতু সব শ্রমিক এখনও আসেনি তাই এটি নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে বলেও দাবি অনেক কারখানা মালিকের। অনেক কারখানা প্রয়োজনে একাধিক শিফটের ব্যবস্থা করতে পারে এমন ইঙ্গিতও দিয়েছে।
গতকাল থেকেই গাজীপুরের কারখানাগুলোতে কাজ করা শ্রমিকদের বেশিরভাগ উপস্থিত হন বিভিন্ন উপায়ে। যদিও বিজিএমই-র নির্দেশনা ছিল, শুধু আশেপাশের শ্রমিকরাই স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানায় কাজে যোগ দেবে। দূরে গ্রামে থাকা শ্রমিকদের এই মুহূর্তে না এলেও চলবে। এজন্য তাদের চাকরিচ্যুত করা যাবে না। তবে বিভিন্ন কারখানার শ্রমিকদের অভিযোগ, দূরে থাকলেও গত দুদিন ধরে তাদের ফোন করে আসতে বলা হয়েছে। এজন্য তারা চলে এসেছেন। গণপরিবহন বন্ধ থাকায় শ্রমিকেরা অতিরিক্ত ভাড়ায় রিকশা, ভ্যান, মাছের ট্রাক ও সবজির ট্রাকে করেও বিভিন্ন জেলা থেকে গাজীপুরের বিভিন্ন এলাকার পোশাক কারখানায় তারা কাজে যোগদান করেন। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা শ্রমিকরা বলেন, না এসে উপায়ও নেই। হয় ছাঁটাইয়ের তালিকায় পড়তে হবে, না হলে বেতন-বোনাস আটকিয়ে রাখবে কারখানা কর্তৃপক্ষ। তাই সব দিক বিবেচনা করেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজে যোগ দিতে হচ্ছে আমাদের। আবার দুই একজন কারখানায় এসে ছাঁটাই হয়ে যাওয়ার অভিযোগ করেছেন।
গাজীপুর সদর উপজেলার তেলিপাড়া এলাকার এডিশন ফুট ওয়্যার লিমিটেড কারখানার শ্রমিক কামাল হোসেন বলেন, রবিবার থেকে কারখানা খোলা। সকালে কারখানায় এসে জানতে পারি আমার চাকরি নাই। আমি এখানে যোগদান করেছি দুই মাস হয়েছে। তাই চাকরি স্থায়ী না হওয়ায় কর্তৃপক্ষ আমাকে কারখানায় ঢুকতে দেয়নি। তাহলে কারখানা কর্তৃপক্ষ কেন আমাকে ফোন দিয়ে এত কষ্ট করে বাড়ি থেকে আসতে বললো? গার্মেন্টস শ্রমিক বলে আমাদের জীবনের কি কোনও মূল্য নেই?
গাজীপুর মহানগরের বোর্ড বাজার এলাকার হান্নান গ্রুপের লিংকিং অপারেটর আলম মিয়া বলেন, গত শুক্রবার কারখানার সুপারভাইজারকে ফোন দিলে তিনি কারখানায় আসতে বলেন। পেটের তাগিদে করোনা ঝুঁকি নিয়েই আমরা কাজে যোগ দিয়েছি।
গাজীপুরের পিমকি অ্যাপারেলস কারখানার কাটিং অ্যাসিস্ট্যান্ট মোমিন মিয়া বলেন, একদিকে বাড়ি থেকে আসতে পুলিশি বাধার মুখে পড়তে হয়েছে। অপরদিকে, রবিবার সকালে কারখানায় কাজে যোগ না দিলে চাকরি যাওয়ার হুমকি ছিল। এ কারণে অসুবিধা হলেও আমাদের আসতে হয়েছে।
কারখানার নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক দুই পোশাক কর্মী রুবিনা আক্তার ও তানজিলা আক্তার বলেন, আমাদের ফোন করে বলা হয়েছে রবিবার সকাল ৭টার মধ্যে গার্মেন্টস খুলবে। সকাল ৭টার আগেই কাজে যোগদান করতে হবে। আমরা যদি সঠিক সময়ে না যাই চাকরি চলে যাবে। তাই শত কষ্ট হলেও কাজে যোগ দিয়েছি।
কারখানায় করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে কিনা এমন প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, তাপমাত্রা মাপা ও হাতধোয়ার নির্দেশ মানা হয়েছে। তবে ভেতরের পরিবেশ কেমন সেটা কেবল আমরাই বলতে পারবো। মানছে না কারখানা কর্তৃপক্ষ। করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি সত্ত্বেও জীবন হাতে নিয়ে যথা সময়ে কারখানায় উপস্থিত হয়েছি। আমরা শ্রমিকরা কারখানা মালিকের নির্দেশ মেনেছি, এবার আমরা চাই কারখানা মালিকরা আমাদের বাঁচাতে সরকারের সব নির্দেশ মানুক। আমাদের পুরো নিরাপত্তা দিয়ে কাজ করতে বললে তো আামাদের আপত্তি নাই। আর যদি তারা নির্দেশ না মানেন, আর কোনও শ্রমিক যদি আক্রান্ত হই তাহলে পুরো কারখানাই আবার লকডাউন হয়ে যাবে। মালিকরাও নিশ্চয় এই রিস্ক বুঝবেন।
গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) সুশান্ত সরকার জানান, আজ রোববার থেকে গাজীপুরে প্রায় সাড়ে চারশ’ পোশাক কারখানা স্বাস্থ্যবিধি ও সামাজিক দূরত্ব মেনে স্বল্প সংখ্যক শ্রমিক নিয়ে কাজ শুরু করেছে। আমরা এসব কারখানায় মনিটরিং করছি যেন কারখানাগুলো শতভাগ স্বাস্থ্যবিধি মেনে শ্রমিকদের কাজ করায়।
গাজীপুরের জেলা প্রশাসক (ডিসি) এস এম তরিকুল ইসলাম জানান, জেলার বেশিরভাগ কারখানা’ই কমপ্লায়েন্স নিয়ম মেনে চলে। তাছাড়া জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক মোবাইল টিম, কলকারখানা ও প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন অধিদফতরের কর্মকর্তা ও শিল্প পুলিশ রয়েছে। তারা সবসময় কারখানাগুলোর দিকে নজর রাখছে যেন করোনাভাইরাস মোকাবিলায় সরকারি নির্দেশনা মেনে ওইসব কারখানা শ্রমিকদের কাজ করায়।
তিনি বলেন, সরকারি নির্দেশনা মানা হচ্ছে না,এরকম কোনও অভিযোগ আমরা পাইনি। শর্ত সাপেক্ষে শ্রমিক নিরাপত্তা ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে কারখানা খোলা রাখার অনুমতি দেওয়া হয়েছে। এজন্য সরকারি নির্দেশ সবাইকে মেনে চলার ও সচেতন থাকার পরামর্শও দেন তিনি।

চাকরি ফিরে পেতে শ্রমিকদের বিক্ষোভ ::
গাজীপুরের মির্জাপুর (তালতলী) এলাকার এডিসন ফুটওয়্যার লিমিটেডের শ্রমিকেরা চাকরি ফিরে পাওয়ার দাবিতে বিক্ষোভ করেছে। রবিবার সকাল ৯টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত চলতি বছরে নিয়োগ পাওয়া শ্রমিকেরা বিক্ষোভ করে।

শ্রমিকেরা জানান, গত ১১ এপ্রিল আন্দোলন বিক্ষোভে বাধ্য হয়ে কর্তৃপক্ষ ১৬ এপ্রিল কিছু শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করেন। কিন্তু যেসব শ্রমিক চলতি বছর নিয়োগ পান এরকম কমপক্ষে পাঁচশ’ শ্রমিকের কাছ থেকে কর্তৃপক্ষ বেতন পরিশোধ ছাড়াই জোর করে সাদা কাগজ, আবার কারও পদত্যাগ পত্রে স্বাক্ষর নিয়ে পরিচয়পত্র রেখে দেন। এরপর কর্তৃপক্ষ পরবর্তী ২৬ এপ্রিল কারখানায় যোগদান করতে বলেন। কর্তৃপক্ষ শুক্র ও শনিবার ফোন করে অনেক শ্রমিককে রবিবার থেকে কারখানায় যোগদান করতে বলে। ওই কারখানায় দুই হাজারের অধিক শ্রমিক রয়েছে বলে জানান শ্রমিকরা।

প্রত্যক্ষদর্শীরা জানায়, রবিবার সকাল সাতটার দিকে পূর্ব ঘোষিত সময় অনুযায়ী শ্রমিকেরা কারখানায় যোগ দিতে যায়। যেসব শ্রমিক চলতি বছর নিয়োগ লাভ করেন তাদেরকে কর্তৃপক্ষ কারখানায় ঢুকতে দেয়নি। এ নিয়ে শ্রমিকেরা বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে। এক পর্যায়ে শ্রমিকেরা ভেতের ঢুকতে কারখানার গেটে হামলা করে।

- Advertisement -

এ ব্যাপারে এডিসন ফুটওয়্যার লিমিটেডের সহকারি মহা-ব্যবস্থাপক (এজিএম) বিপুল বরণ ঘোষ বলেন, সকল শ্রমিকের বেতন পরিশোধ করা হয়েছে। কারও বেতন বকেয়া রাখা হয়নি। শ্রমিকদেরকে রবিবার আসতে বলা হয়েছিল। কিন্তু গাজীপুর এলাকায় ২ মে কারখানা খোলার নির্দেশ পাওয়ার পর গাজীপুর সদর থানা পুলিশ বিষয়টি তাদের অবহিত করলে কারখানা ছুটি দেওয়া হয়।

গাজীপুর সদর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) জাবেদুল ইসলাম বলেন, যেসব শ্রমিকের পরিচয়পত্র রেখে দিয়েছিল তাদের পরিচয়পত্র ফেরত দেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অনেকের পরিচয়পত্র ফেরত দেওয়া হয়েছে। তাদের চাকরি থেকেও বাদ দেওয়া হবে না। কারখানা কর্তৃপক্ষ পুলিশকে এরকম নিশ্চয়তা দেওয়ার পর শ্রমিকেরা কারখানা এলাকা ত্যাগ করেন।

গাজীপুর শিল্প পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (এডিশনাল এসপি) জালাল আহমেদ বলেন, পুলিশ লাঠিচার্জ করেনি। কারখানা চালু রাখার জন্য সরকারি নিয়ম মেনে চলার জন্য তাগিদ দেওয়া হয়েছে। পুলিশ শ্রমিকদের মানবিক বিষয় নিয়েই কথা বলেছে।

- Advertisement -
- Advertisement -