স্মৃতিতে অম্লান মাষ্টার ইমান আলী

0
427

বিশেষ প্রতিনিধি : ১৯১৪ সাল থেকে শুরু প্রথম বিশ্বযুদ্ধ ১৯১৮ সালে শেষ হতে দেখা যায়, অর্থনৈতিক মন্দার এক দশক পরেই ১৯২৯ সালে সারা বিশ্বে অর্থনৈতিক মহামন্দা শুরু হয়। ইউরোপ এশিয়া সহ সারাবিশ্ব তার কবলে পরে। বোমা বারুদ, রোগ ব্যাধিতে সারা বিশ্বের নিষ্পেষিত জনতা মানবেতর জীবন যাপন করে। তেতো হয়ে যায় মাঠ ঘাট নগর বন্দর। সাম্রাজ্যবাদী অর্থনীতিতে চলে ব্যাপক মন্দা। নিজেদের স্বার্থ সিদ্ধি করার জন্য চলে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ।
১৯৩৯-১৯৪৫ পর্যন্ত ৫বছর চলে কলোনী দখলের যুদ্ধ। সারা ভারত বর্ষে ক্ষুধা দারিদ্র্য, দুর্ভিক্ষে, রোগ ব্যাধিতে লাখ লাখ মানুষ মারা যায়। প্রথম ও দ্বিতীয় যুদ্ধের মাঝামাঝি সময় মাস্টার ইমান আলীর জন্ম হয় । এশিয়া মহাদেশের বৃহত্তম বটগাছ ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ থানার মল্লিকপুর গ্রামের ডাক্তার বাড়িতে, বাবা ছিলেন ওয়ারেশ আলী, মা আছিয়া খাতুনের ঘর আলোকিত করে জন্ম গ্রহণ করেন মাস্টার ইমান আলী। গোটা পরিবার ছিল প্রগতিশীল চিন্তাধারার। বড় ভাই ডা. লুতফর রহমান বিশ্বাস, খেলাফত বিশ্বাস, বেলায়েত হোসেন, জহর আলী বিশ্বাস, এলাহী বিশ্বাস ও মোহাম্মদ আলী বিশ্বাস ।
বেলায়েত হোসেন ১৯৩৩ সালে মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা করেন। সাত ভাইয়ের মধ্যে মাস্টার ইমান আলী ছিলেন সর্বকনিষ্ঠ। যশোর জিলা স্কুল থেকে ১৯৪৫ সালে মেট্রিকুলেশন পাস করেন। স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় ব্রিটিশ সাহেবদের কর্তৃক দেশের জনগণের উপর অত্যাচার অনাচারের বিরুদ্ধাচারণ করায়  ব্রিটিশ সরকারের  পুলিশের দ্বারা নির্মমভাবে নির্যাতিত নিগৃহীত হন কয়েক বার ।
আবার ১৯৪৮ সালে রাষ্ট্রভাষার দাবীতে যশোর উত্তাল হয়ে ওঠে। যশোর মাইকেল মধুসূদন কলেজে গঠিত হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। মাষ্টার ইমান আলী সেই রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের আহ্বায়ক হিসাবে ১৯৪৮ সালের ১১ এবং ১২ মার্চ ছাত্র ধর্মঘট ১৩ মার্চ হরতালের নেতৃত্ব প্রদান করেন এবং ১৪৪ ধারা ভাঙ্গার ব্যাপারে রাজনৈতিক নেতাদের কারো কারো মধ্যে দ্বিধাদ্বন্দ্ব থাকলেও ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের ধর্মঘট সফল ও মিছিল বের করার সিদ্ধান্তে মাষ্টার ইমান আলী অটল ছিলেন। ১৩ মার্চ-এর ধর্মঘট চলাকালীন সময়ে মাষ্টার ইমান আলী পাকিস্তানী শাসকদের হাতে গ্রেফতার হন। ১৯৫২ সালে যশোরে প্রথম ” শহীদমিনার ” নির্মাণে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন।
১৯৫০ দশকে পাকিস্তান সিভিল সাপ্লায়ার বিভাগে ইন্সপেক্টর পদে চাকরিতে যোগদান করেন। কিন্তু বিধি বাম সেখানে বসে স্বাধীন চেতা প্রগতিশীল মনোভাব, সরকারী কর্মকর্তা হিসেবে কর্মজীবন বাধাগ্রস্ত করে তোলে। কৃষক জনতার ভালোবাসা , পাকিস্তানে দ্বিমুখী নীতি পুর্বপাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিমাতাসুলভ আচরণের কথা সরকারী চাকরিরত অবস্থায় বলায় তাকে সন্দেহ, অবিশ্বাস করা হয়। পাকিস্তান রাষ্ট্রবিরোধী কথা বলায় পাকিস্তানের লাহোর থেকে ট্রাম্পকলের মাধ্যমে তাকে চাকরিচ্যুত করে  এবং আর কোনদিন সরকারী চাকরি করতে পারবে না বলে নির্দেশ দেওয়া হয়।
পরবর্তী ১৯৫৬ সালে মাষ্টার ইমান আলী গণতান্ত্রিক পার্টিতে যোগদান করেন। গণতান্ত্রিক পার্টির বিলুপ্তির পর মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বাধীন ন্যাশনাল আওয়ামি পার্টি (ন্যাপ)-এ যোগদান করেন। ১৯৬৯ সালে যশোরে কৃষক সমিতির সভা অনুষ্ঠিত হয় এ সভায় বক্তব্য রাখেন কমরেড আব্দুল হক, আব্দুল মালেক, মারুফ হোসেন প্রমুখ। এই সভা সফল করতে তিনি ব্যাপক ভূমিকা রাখেন। ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যূত্থানে তিনি নেতৃত্বের ভূমিকা পালন করেন। ১৯৮০ সালের ২৪ জানুয়ারী তিনি বাংলাদেশ কৃষক সংগ্রাম সমিতি প্রতিষ্ঠায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। ১৯৯৩ সাল পর্যন্ত তিনি এ সংগঠনের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতির দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯৩ সালের ১৮ ও ১৯ ফেব্রুয়ারী ৭ম জাতীয় সম্মেলনের মধ্যদিয়ে তিনি কেন্দ্রীয় সভাপতি নির্বাচিত হন এবং আমৃত্যু এ দায়িত্ব পালন করেন। তিনি কৃষক-শ্রমিক মেহনতি মানুষের মুক্তির লক্ষ্যে একটি শোষণমুক্ত সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে আজীবন সংগ্রাম করে গেছেন। ১৯৫৯ সালের প্রথম থেকেই তিনি মাইকেল মধুসূদন (এম.এম) কলেজ প্রতিষ্ঠায় জমি সংগ্রহ ও ইমারত নির্মাণ প্রকল্প কমিটির সদস্য হিসাবে ভূমিকা রাখেন এবং কলেজের প্রতিষ্ঠাতা হিসাবে স্বীকৃতি পান। যশোর সিটি কলেজ প্রতিষ্ঠা, খুলনার পাইকগাছা থানার বেতকাশিতে একটি প্রাথমিক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
মাষ্টার ইমান আলী “বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে কৃষক ও কৃষির সমস্যাই মূলত : জাতীয় সমস্যা” এ বক্তব্যকে মূল প্রতিপাদ্য বিষয় হিসেবে গ্রহণ করে কৃষক সংগঠন ও আন্দোলন সংগঠিত করেন। আজীবন এ সংগ্রামী নেতা বিশ্বাস করতেন শোষণমূলক এ সমাজ ও রাষ্ট্রব্যবস্থার পরিবর্তন ছাড়া কৃষক, শ্রমিক, মেহনতী মানুষের মুক্তি সম্ভব নয়। তাই তিনি সকল প্রলোভনের হাতছানিকে উপেক্ষা করে জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নিঃস্বার্থভাবে জনগণের মুক্তির সংগ্রামে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন।
তার বৈবাহিক জীবনে সহধর্মিণী ছিলেন প্রয়াত মানবতার অগ্রদূত মোসাম্মৎ মোশারেফা খাতুন শেফালী চার পুত্র এক কন্যা যথাক্রমে মোঃ মারুফ হোসেন তুগরিল, মোঃ কবির হোসেন খোকন, মোঃ মুনির হোসেন মনি, মোঃ মোজাফফর হোসেন বাবু ও এক আদরের কন্যা বুড়ি। নিজে অর্থনৈতিক সংকটে থেকেও বহু ছাত্রছাত্রীকে নিজের টাকায় পড়িয়েছেন। স্মৃতিতে অম্লান মাষ্টার ইমান আলী ! আগামী ২৬ মে ১৬তম মৃত্যুবার্ষিকী ! তার প্রতি রইল বিনম্র শ্রদ্ধা—
“নিঃশেষে প্রাণ যে করিবে দান।
ওরে ক্ষয় নাই তার ক্ষয় নাই”
আলোকিত/২০/০৫/২০২৪/আকাশ

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here