ড. মো. আখতারুজ্জামান:
মধ্যযুগের ভারত ও বাংলার আর্থ-সামাজিক ও নগর ইতিহাস বিষয়ে আলীগড় মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি গবেষণাকালে সমসাময়িক ইতিবৃত্তকার ও ঐতিহাসিকদের লেখায় যখন কয়েকজন মুসলিম শাসকের জনহিতকর কিছু কার্যক্রম, বিশেষ করে ভূমি রাজস্বহার কমানো, ভূমি বন্দোবস্ত, কূপ খনন, রাস্তা নির্মাণ, পান্থশালা স্থাপন, লঙ্গরখানা খোলা প্রভৃতির প্রশংসামূলক উল্লেখ দেখি, তখন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশে নানা মানবিক উদ্যোগের কথা স্মরণে আসত। কারণ মহান মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পর সাড়ে সাত কোটি মানুষ আর অর্থ ও প্রাকৃতিক সম্পদবিহীন বিধ্বস্ত ৫৬ হাজার বর্গমাইলের একটি দেশ নিয়ে ১৯৭২ সালে যখন তিনি রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন, তখন তিনি হতাশ ও বিচলিত না হয়ে বাংলার মাটি ও মানুষ—এ দুটিকে অপার সম্ভাবনার সম্পদ হিসেবে গণ্য করে প্রথমেই হতদরিদ্র, সুবিধাবঞ্চিত, অসহায়, প্রান্তিক মানুষের কল্যাণে নানা সাহসী পদক্ষেপ গ্রহণ শুরু করেন আজীবন লালিত উচ্চতর মানবিক মূল্যবোধে তাড়িত হয়ে। ওই পিএইচডি অভিসন্দর্ভটি Society and Urbanization in Medieval Bengal শিরোনামে এশিয়াটিক সোসাইটি অব বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হয় ২০০৮ সালে। বইটি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব, যিনি সুবিধাবঞ্চিত গরিব মানুষের ভাগ্যোন্নয়নে অবদান রেখেছেন এবং নানা পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন, তাঁর নামে উৎসর্গীকৃত। আজ যখন বঙ্গবন্ধুকন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার, বিশেষ করে প্রান্তিক গরিব মানুষের জীবনমান উন্নয়নে গৃহীত মানবিক উদ্যোগগুলো পর্যালোচনা করি, তখন ভাবি ভবিষ্যতে অর্থনীতি, গণমানুষ ও সমাজ উন্নয়নবিষয়ক বহু মৌলিক গবেষণাকর্মে তাঁর নাম উল্লেখ থাকবে দেশে ও বিদেশে; উৎসর্গীকৃত হবে বহু গ্রন্থ। অবহেলিত মানুষের জীবনমান উন্নয়নে ‘আশ্রয়ণ’বাঙালির গণমানুষের অবিচ্ছিন্ন অংশ মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব গণমানুষের মধ্যে থাকা ছিন্নমূল-অসহায়-ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের কথা ভেবে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন সেই ১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতেই। তৎকালীন নোয়াখালী জেলা, বর্তমান লক্ষ্মীপুর জেলার চর পোড়াগাছা গ্রামের সরেজমিনে গিয়ে পরিদর্শন করে বঙ্গবন্ধু গরিব মানুষের দুর্দশা লাঘবে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে। সেই চর পোড়াগাছা গ্রাম থেকে শুরু হওয়া ভূমিহীন-গৃহহীন মানুষের পুনর্বাসনের মাধ্যমে তিনিই প্রথম এ দেশের ছিন্নমূল-অসহায়-দরিদ্র মানুষের পুনর্বাসনের মাধ্যমে তাদের ভূমির অধিকার নিশ্চিত করেন। ৩ জুন ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সমবায় ইউনিয়ন আয়োজিত সমবায় আন্দোলনে প্রদত্ত এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘আমার দেশের প্রতিটি মানুষ খাদ্য পাবে, আশ্রয় পাবে, শিক্ষা পাবে, উন্নত জীবনের অধিকারী হবে, এই হচ্ছে আমার স্বপ্ন।’ দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রে নরপিশাচ ঘাতকরা জাতির পিতার উন্নত-সমৃদ্ধ মানবিক দেশ গঠনের স্বপ্ন সফল করতে সময় দেয়নি। তাঁর অসমাপ্ত কাজ শেষ করার ইস্পাতদৃঢ় প্রত্যয় বুকে ধারণ করে দীর্ঘ আন্দোলন-সংগ্রাম শেষে বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা নব্বইয়ের দশকের মাঝামাঝি সরকার পরিচালনার দায়িত্ব নিয়ে ১৯৯৭ সালেই এ দেশের দরিদ্র-অসহায়-ছিন্নমূল মানুষকে পুনর্বাসনের লক্ষ্যে ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প গ্রহণ করেন। সে বছর মে মাসে কক্সবাজার জেলার টেকনাফের সেন্ট মার্টিন দ্বীপ প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হলে তিনি সেখানে ছুটে যান। পিতা বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে তাৎক্ষণিকভাবে সেখানে গৃহহারা মানুষের জন্য ঘর তৈরি করে দিয়ে পুনর্বাসনের নির্দেশ দিয়েছিলেন। তারই ধারাবাহিকতায় সে বছরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সরাসরি তত্ত্বাবধানে কর্মোদ্যোগ বাস্তবায়নের এক নতুন ধারণায় ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশের সর্বত্র পিছিয়ে পড়া গৃহহারা-ছিন্নমূল-অসহায় মানুষের নিজস্ব ঠিকানা ও মাথা গোঁজার ঠাই নিশ্চিত করার মহান কাজ শুরু করা হয়। ২০০৯ সালে তাঁর নেতৃত্বে আবার সরকার গঠন করার পর এই মহতী উদ্যোগ অধিকতর গতি পায়; সামাজিক সুরক্ষার নানাবিধ কাজের ব্যাপ্তি বাড়তে থাকে। জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী ‘মুজিববর্ষে’ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন ঘোষণা করেন, ‘বাংলাদেশে একজন মানুষও গৃহহীন থাকবে না।’ তখন এ কাজটি পায় একটি ভিন্নমাত্রা। সামাজিক সুরক্ষার এই তালিকায় অন্তর্ভুক্ত হয় জলবায়ু, উদ্বাস্তু, ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠী, তৃতীয় লিঙ্গ, ভিক্ষুক, বেদে, দলিত, মাণ্ডা, বাগদি, হরিজন, কুষ্ঠ রোগীসহ সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী। সমাজের এসব অবহেলিত মানুষকে উন্নয়নের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য প্রধানমন্ত্রীর নিজস্ব দর্শন ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে’ শেখ হাসিনা মডেল জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আলোচনা ও উদ্ভাবনের সুযোগ তৈরি করে। কোনো সন্দেহ নেই, জেনেটিক সূত্রে পিতা-মাতার মহৎ গুণাবলি তিনি বহন করছেন। তাই পিতা মুজিবের সূচিত পথ অনুসরণ করেই মানবিক উদ্যোগগুলো তিনি গ্রহণ করেছেন। তবে এ ক্ষেত্রে সহস্রাব্দ উন্নয়ন অভীষ্ট (এমডিজি : ২০০০-২০১৫) ও টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট (এসডিজি : ২০১৬-২০৩০) অর্জনের কৌশল হিসেবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা উল্লিখিত মডেলের ধারণার সূত্রপাত ও বিকাশ ঘটান এবং সে আলোকে প্রকল্প গ্রহণ করেন বলে আমার দৃঢ় বিশ্বাস। উদ্ভাবিত এই মডেলে মানুষের উপার্জনক্ষমতা বৃদ্ধি, সম্মানজনক জীবিকা ও সামাজিক মর্যাদা প্রতিষ্ঠা, জমিসহ ঘরের মালিকানায় নারীর ক্ষমতায়ন, আত্মবিশ্বাস ও আত্মমর্যাদাবোধ অর্জন, দক্ষতা উন্নয়ন, পরিবেশ সুরক্ষা ও গ্রামেই শহরের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা প্রভৃতি মৌলিক বৈশিষ্ট্য অন্তর্ভুক্ত রয়েছে। নতুন এই মডেল প্রকল্পে সুবিধাভোগীদের আয়, সঞ্চয়, খাদ্যনিরাপত্তা, সামাজিক সচেতনতা, শিশুদের শিক্ষা গ্রহণের হার, স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সুযোগ, নারীর ক্ষমতায়ন, জীবন দক্ষতাসহ নানা ধরনের সূচকে ব্যাপক উন্নতি হয়েছে কোনো সন্দেহ নেই; তবে এ বিষয়ে সমাজ ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন গবেষকদের মৌলিক গবেষণার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে বলে আমার ধারণা। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে এই প্রকল্প বিষয়ে এরই মধ্যে ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছে। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশন উপলক্ষে নিউ ইয়র্কে বাংলাদেশ ও UN-Habitat-এর যৌথ উদ্যোগে ২১ সেপ্টেম্বর ২০২২ সালে অনুষ্ঠিত High Level Side Event-এ একটি বিষয় ছিল ‘Ensuring Safe And Affordable Housing for All : Achieving SDG Target 11.10’, এ অনুষ্ঠানে ‘আশ্রয়ণ : অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে শেখ হাসিনা মডেল’ নিয়ে কৌতূহলোদ্দীপক আলোচনা হয়। উল্লেখ্য, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এই উদ্যোগ একটি মৌলিক ভাবনা ও সৃজনশীল কর্ম হিসেবে সম্প্রতি বাংলাদেশ কপিরাইট অফিস কর্তৃক কপিরাইট স্বীকৃতি অর্জন করেছে। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা ২০২৩-এ পরিবেশিত এক পরিসংখ্যানে জানা যায় যে আশ্রয়ণ প্রকল্পসহ অন্যান্য সমধর্মী কাজের মাধ্যমে এ পর্যন্ত আট লাখ ২৩ হাজার ঘরবাড়ি বানানো হয়েছে এবং প্রায় ৪১ লাখেরও বেশি হতদরিদ্র মানুষ পুনর্বাসিত হয়েছে। তবে কতটি ঘর নির্মাণ করা হলো বা কতজন মানুষ এর আওতায় এলো তার চেয়েও তাৎপর্যময় বিষয় হলো, একটি উদ্ভাবনমূলক কর্মোদ্যোগ এবং একটি জাতির সামগ্রিক অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়নে এর সুদূরপ্রসারী ভূমিকা। জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন অভীষ্টগুলো (Sustainable Development Goals) পর্যালোচনায় স্পষ্টত প্রতীয়মান হয় যে এর ১৭টি অভীষ্টের অন্তর্গত ১৬৯টি লক্ষ্যমাত্রার অনেকগুলো মৌলিক লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে এই নতুন দর্শনের ‘আশ্রয়ণ’ প্রকল্প প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখছে। অধিকন্তু একটি উদ্ভাবনমূলক কর্মপ্রয়াস অধিকতর উদ্ভাবনের সুযোগ করে দেবে এবং নতুন প্রজন্মকে সুষম উন্নয়ন, অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবিক ও উদ্ভাবনমুখী সংস্কৃতি অনুশীলনে অনুপ্রাণিত করবে।
লেখক : উপাচার্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়