[bangla_time] | [bangla_day] | [bangla_date] | [english_date] | [hijri_date]

রাজনীতি কারো হাতের খেলনা নয়

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

আলী হাবিব

রাজনীতিতে ঈদের আলাদা একটা প্রভাব আছে। বিশেষ করে যখন নির্বাচন সামনে চলে আসে, তখন রাজনৈতিক ঈদ বা ঈদের রাজনীতি বেশ জমজমাট হয়ে ওঠে। এবার ঈদে রাজনৈতিক শুভেচ্ছা বিনিময়ে বৃষ্টি তাই বড় বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারেনি।  ঈদের আগে গাজীপুর, সিলেট, খুলনা, বরিশাল ও রাজশাহী—এই পাঁচ সিটি করপোরেশনে নির্বাচন হয়েছে। এসব নির্বাচন ছিল শান্তিপূর্ণ ও মোটামুটি বিতর্কহীন। ভোটার উপস্থিতিও ছিল সন্তোষজনক। স্বাভাবিকভাবেই সন্তুষ্ট ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ। তারা মনে করছে, ‘বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচনে মানুষের আগ্রহ নেই’—এমন প্রচারের বিরুদ্ধে এখন সরকার জোর গলায় কথা বলতে পারবে। এ ছাড়া এই নির্বাচনকে নিজেদের জয়ের মাইলফলক হিসেবেই দেখছে আওয়ামী লীগ। ক্ষমতাসীন দলটি এখন বলতে পারছে, ‘জনগণের উপস্থিতি ও স্বতঃস্ফূর্ত ভোটদান প্রমাণ করেছে, নির্দিষ্ট কোনো দল নির্বাচনে অংশ না নিলেও নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক হয়।’ তাদের ধারণা, আগামী জাতীয় নির্বাচনে যে আওয়ামী লীগ বড় ব্যবধানে জয় পাবে, এটি তারই পূর্বাভাস। অন্যদিকে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একটি পক্ষের মতে, ‘এই নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া বলা যাবে না। ’ কারণ ‘এই নির্বাচনে তেমন প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না প্রতিদ্বন্দ্বিতা না থাকায় একতরফা নির্বাচন হয়েছে।’ আবার এবারের সিটি নির্বাচনের ইতিবাচক দিকও দেখছে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের আরেক পক্ষ। তারা মনে করছে, আড়ষ্টতা কাটিয়ে প্রায় ৫০ শতাংশ ভোটার ভোটকেন্দ্রে গেছেন। পরিবেশ কিছুটা ভালো হয়েছে। তাদের ধারণা, মানুষ ভোটকেন্দ্রমুখী হবে। নতুন ভোটার, যাঁরা এবার প্রথম ভোট দিয়েছেন, তাঁরা আগামী নির্বাচনেও ভোট দিতে উৎসাহিত হবেন। যাঁরা এই সিটি নির্বাচনকে জাতীয় নির্বাচনের মহড়া মানতে নারাজ, তাঁরা যে ইঙ্গিতটি করেছেন, তা স্পষ্ট। আর সেটি হচ্ছে, একটি রাজনৈতিক দল এসব নির্বাচনে অংশ না নেওয়ায় নির্বাচনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল না। এই পর্যবেক্ষকরা আগে বলতেন, ‘অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন’। এখন তাঁরা সেই অবস্থান থেকে সরে এসে বলতে চাইছেন, ‘প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ নির্বাচন। এবং কেবল নির্দিষ্ট একটি দল নির্বাচনে এলেই যে নির্বাচন ‘অংশগ্রহণমূলক ও প্রতিদ্বন্দ্বিতামূলক’ হবে, সেটি তাঁরা আকার-ইঙ্গিতে বোঝাতে চাইছেন। অন্যদিকে কোনো কোনো রাজনৈতিক দল মনে করছে, পাঁচ সিটি করপোরেশন নির্বাচনে অংশ না নিয়ে তারা নির্বাচনব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করতে পেরেছে, যদিও এটা স্পষ্ট যে তাদের অংশগ্রহণের ওপর এখন নির্বাচন নির্ভর করছে না। ঈদের আগে দেশের রাজনৈতিক অঙ্গনে আরেকটি আলোচিত বিষয় ছিল গণ অধিকার পরিষদ। শীর্ষ নেতৃত্বের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্যে আসার পর রেজা কিবরিয়াকে গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়কের পদ থেকে সরিয়ে প্রথম যুগ্ম আহ্বায়ক মো. রাশেদ খানকে ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক করার ঘোষণা দেয় সদস্যসচিব নুরুল হক নুরের অনুসারীরা। পাল্টা পদক্ষেপে গণ অধিকার পরিষদের সদস্যসচিব নুরুল হক নুরকে তাঁর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়ার ঘোষণা দিয়ে আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়া নুরের স্থানে আনেন হাসান আল মামুনকে, যিনি একসময় ছাত্র অধিকার সংরক্ষণ পরিষদের আহ্বায়ক ছিলেন। গত শনিবার এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গণ অধিকার পরিষদের আহ্বায়ক রেজা কিবরিয়াকে দল থেকে ‘অপসারণ’ করা হয়েছে। এই সিদ্ধান্ত অবৈধ বলেছেন রেজা কিবরিয়া।ইসরায়েলের গোয়েন্দা সংস্থা মোসাদের সঙ্গে নুর বৈঠক করেছেন—এমন অভিযোগ উঠেছে। গণ অধিকার পরিষদে চলছে তোলপাড়। ওই বৈঠক শেষে নুর মোটা অঙ্কের টাকা নিয়েছেন বলে অভিযোগ তুলেছেন তাঁরই দলের সদস্যরা। ঢাকায় নিযুক্ত ফিলিস্তিনের রাষ্ট্রদূতের দাবি, কাতার, দুবাই ও ভারতে ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের সঙ্গে তিনবার বৈঠক করেছেন গণ অধিকার পরিষদের নেতা নুরুল হক নুর। ইসরায়েলের ক্ষমতাসীন দল লিকুদ পার্টির সদস্য মেন্দি সাফাদির সঙ্গে গত জানুয়ারিতে বৈঠক করার অভিযোগ ওঠে নুরের বিরুদ্ধে। সামাজিক মাধ্যম ফেসবুকে এমন একটি ছবি পোস্ট করা হয়। নুরুল হক নুর অবশ্য সব সময় এসব অভিযোগ অস্বীকার করে এসেছেন। রাজনৈতিক নেতৃত্ব একটি দীর্ঘ সংগ্রামপ্রক্রিয়ার ফসল। নেতৃত্ব অর্জনের কোনো শর্টকাট রাস্তা নেই। দীর্ঘ পথপরিক্রমার মধ্য দিয়ে যেতে হয়। ক্ষমতায় যাওয়া কিংবা সরকার গঠনের বিষয়টিও একটি দীর্ঘ প্রক্রিয়া। এমন নয় যে গাছ থেকে টুপ করে ক্ষমতার মসনদে বসে পড়া যায়। বাংলাদেশের বাস্তবতা হচ্ছে, এখানে রাজনৈতিক দলের নামে কিছু সংগঠন হঠাৎ করেই গজিয়ে ওঠে। তাদের অনেকেই ক্ষমতার মসনদে আসীন হতে চায় শর্টকাট পন্থায়। দেশের সুধীসমাজের একটি অংশও এই ‘হঠাৎ পার্টি’কে সমর্থন দিয়ে থাকে। দেশের মাটির সঙ্গে সম্পর্ক না থাকলে রাজনীতিতে সাফল্য পাওয়া যায় না। বাস্তবতার সঙ্গে সম্পর্ক থাকতে হয়। বাইরের নির্দেশিত কোনো আন্দোলন বাংলাদেশে কখনো সফল হয়নি। যেমন সফল হয়নি হঠাৎ করে গজিয়ে ওঠা কোনো রাজনৈতিক দল। একেক সময়ে হঠাৎ গজিয়ে ওঠা এমন নামসর্বস্ব দলের সংখ্যা দেশে একেবারে কম নয়। যেকোনো দেশে একটি রাজনৈতিক দলের জন্ম হয় জনগণের মধ্য থেকে। জনগণ ঐক্যবদ্ধ হয়। গড়ে তোলে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। এর জন্য জনগণকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। ব্যতিক্রম কি হতে পারে না? পারে। উদাহরণ আমাদের দেশেই আছে। ক্ষমতায় থাকা অন্তত দুটি রাজনৈতিক দল জনগণের মধ্য থেকে গড়ে ওঠেনি। এসব দলের জন্ম উর্দির পকেট থেকে। জন্মের পর এসব দল অন্যান্য দল থেকে রাজনীতিবিদ ‘পারচেজ’ করেছে। কেনাবেচার রাজনীতিতে বিশ্বাসী এসব দলের কোনো নীতি-আদর্শ নেই। উদাহরণ দেওয়া যাক। একজন সামরিক শাসক বেসামরিক লেবাসে নিজের হাতে শাসনক্ষমতা ধরে রাখার জন্য একটি রাজনৈতিক দল গঠনের ইচ্ছা প্রকাশ করলেন। তাঁর অধীন কর্মকর্তারা রাজনীতির বাজার থেকে রাজনৈতিকভাবে বিভ্রান্ত এবং নীতিভ্রষ্ট কিছু রাজনীতিককে নগদ প্রাপ্তিযোগের লোভ দেখিয়ে দলে ভেড়ালেন। পাকিস্তানি জাতীয়তাবাদের আদলে বাংলাদেশি জাতীয়তাবাদের মন্ত্র পাঠ করে পাকিস্তান জিন্দাবাদের ধারাবাহিকতায় ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ জপতে জপতে জন্ম নিল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল। সেই একই ধারাবাহিকতায় আসে জাতীয় পার্টি। জনগণের মধ্য থেকে নয়, কোনো বিদেশি শক্তি কিংবা অন্য কোনো শক্তির ইশারায় বাংলাদেশে আরো অনেক রাজনৈতিক দলের জন্ম হয়েছে। এসব দলের উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে প্রশ্ন আছে। রাজনীতি সবার জন্য সহজ বিষয় নয়। ঘরে বসে রাজা-উজির মারা যায়, রাজনীতি করা যায় না। রাজনীতি করতে হলে জনগণের কাছে যেতে হয়। আমাদের দেশে অনেক রাজনীতিক ও সুধীসমাজের একটি অংশ কথায় কথায় বিদেশিদের কাছে গিয়ে নালিশ করে। একটি দলের তো নামই হয়ে গেছে ‘বাংলাদেশের নালিশ পার্টি’। গণমাধ্যমে বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে ‘হঠাৎ পার্টি’ বা আচমকা গজিয়ে ওঠা রাজনৈতিক দলের অনেক নেতা কিন্তু বুলি কপচানোর ব্যাপারে কারো চেয়ে কম যান না। এই নেতারা জনসাধারণকে স্বপ্ন দেখান। সমাজ থেকে দুর্নীতি দূর করার কথা বলেন। কখনো বলেন না যে পঁচাত্তর-পরবর্তী ‘মানি ইজ নো প্রবলেম’ ও ‘…মেক পলিটিকস ডিফিকাল্ট’ তত্ত্বের প্রবর্তকরা দেশকে দুর্নীতির আখড়ায় পরিণত করেছিলেন। দুর্নীতির শিকড় কোথায়, সেটি তালাশ করেন না। কিছুদিন পর এসব নেতার বিরুদ্ধেই নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ ওঠে। যেমন উঠেছে গণ অধিকার পরিষদের নেতার বিরুদ্ধে। এসব নেতার বক্তব্য শুনলে মনে হবে, তাঁদের আগে কোনো রাজনৈতিক নেতার মধ্যে দেশপ্রেমের চেতনা ছিল না। গণতন্ত্রের জন্য তাঁদের মতো আকুতি কারো নেই। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, তাঁদের রাজনৈতিক কার্যক্রম কি গণতান্ত্রিক ধারায় চলে? না। তেমনটি হলে দেশের স্বার্থের বিরুদ্ধে গিয়ে আন্তর্জাতিক গোয়েন্দা সংস্থার সঙ্গে তাঁরা হাত মেলান কী করে? এ দেশের জনগণের ওপর আস্থা না রেখে তাঁরা বিদেশি শক্তির কাছে ধরনা দেন কেন? এবং সেখানে গিয়ে একতরফা মিথ্যাচার করতে তাঁদের একটুও বাধে না। ঈদের আগে বিএনপি মহাসচিব আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা থেকে হটাতে চূড়ান্ত আন্দোলনে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন। নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকার কেমন হবে তার একটি রূপরেখাও বিএনপি দিতে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এ লক্ষ্যে যুগপৎ আন্দোলনের পথনকশাও নাকি প্রায় চূড়ান্ত করা হয়েছে। সর্বশেষ খবর হলো, এখনই বিএনপি কোনো আন্দোলনে যাচ্ছে না। জুলাইয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তরের নাগরিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও গণতন্ত্র বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি উজরা জেয়া এবং অর্থনৈতিক বিষয়ক আন্ডারসেক্রেটারি জোসে ডাব্লিউ ফার্নান্দেজ আসছেন। এই প্রতিনিধিদলে মার্কিন অ্যাসিস্ট্যান্ট সেক্রেটারি ডোনাল্ড লু থাকছেন। যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের এই তিন কর্মকর্তার বাংলাদেশ সফরকে গুরুত্ব দিচ্ছে বিএনপি। দলের দায়িত্বশীল নেতারাই বলেছেন, এই সফরের পর যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব বুঝে চূড়ান্ত আন্দোলনের কৌশল প্রণয়ন করা হবে। অর্থাৎ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের ওপর নির্ভর করছে বিএনপির রাজনৈতিক কর্মসূচি। সোভিয়েত ইউনিয়ন আমলে বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি কথা চালু ছিল। কমিউনিস্ট পার্টির নেতা-কর্মী-সমর্থকদের উদ্দেশে বলা হতো, মস্কোতে বৃষ্টি হলে ঢাকায় মাথার ওপর ছাতা ধরতেন তাঁরা। এখন তো দেখি ওয়াশিংটনের আবহাওয়ার ওপর নির্ভর করছে আন্দোলনরত দলগুলোর মাথার ওপর রাজনৈতিক ছাতা তুলে ধরা না ধরা। হায়রে দেশপ্রেমিক রাজনৈতিক দল! কেউ কর্মসূচি নিয়ে আমেরিকার দিকে তাকিয়ে, কেউ অপেক্ষায় বিদেশি শক্তি তাদের ক্ষমতায় বসিয়ে দিয়ে যাবে। সবারই ভাবনা তাদের বিকল্প কেউ নেই। রাজনীতি কি দোকানের তাকে সাজিয়ে রাখা খেলনা, ইচ্ছা হলেই যাকে-তাকে কিনে দেওয়া যায়!

লেখক : সাংবাদিক, ছড়াকার

- Advertisement -
- Advertisement -