মইনুল ইসলাম
চলতি বছরের এপ্রিলে আগের বছরের এপ্রিলের চেয়ে ১৬ শতাংশ কম এবং মে মাসে আগের বছরের মে মাসের চেয়ে ১০ শতাংশ কম রেমিট্যান্স আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে এসেছে। অথচ চলতি অর্থবছরে প্রতি মাসে গড়ে এক লাখেরও বেশি বাংলাদেশি জনশক্তি বিদেশে গেছে বলে খবর দিয়েছে ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিং (বিএমইটি)। কিন্তু এই অর্থবছরের শুরু থেকে চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত ৯ মাসে ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবৃদ্ধির হার ডলারের হিসাবে ছিল মাত্র ৫ শতাংশ। এর মানে সিংহভাগ প্রবাসীই হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। এদিকে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠালে ১ ডলারের বিনিময়ে ১০৮ দশমিক ৫০ টাকার বেশি দেওয়া যাবে না মর্মে বাংলাদেশ ব্যাংক নির্দেশনা জারি করেছিল। অথচ নির্দেশনা-পরবর্তী সময়ে কার্ব মার্কেটে ১ ডলারের দাম উঠেছিল ১২০ টাকা পর্যন্ত। স্বাভাবিকভাবেই প্রবাসীদের কাছে হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো অনেক বেশি আকর্ষণীয় হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে হুন্ডির তুলনায় আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ ক্রমে দুর্বল হতে বাধ্য। যদি রেমিট্যান্স প্রবাহ দুর্বল হতে থাকে, তাহলে দেশে ডলার সংকট ও বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ সংকট অদূর ভবিষ্যতে কাটিয়ে ওঠার কোনো সম্ভাবনা নেই। প্রসঙ্গত, আইএমএফ থেকে ৪ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার ঋণ গ্রহণের সময় আমরা এই জুন মাসের মধ্যে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার প্রকৃত রিজার্ভ বাড়িয়ে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী ২৪ দশমিক ৪৬ বিলিয়ন ডলারে নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলাম। কিন্তু জুন মাস শেষ হতে চললেও এ প্রতিশ্রুতি পূরণ আমাদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। আইএমএফের হিসাব পদ্ধতি অনুযায়ী দেশের প্রকৃত রিজার্ভ ২২ বিলিয়ন ডলারের কম। মনে আছে, ২০২০-২১ অর্থবছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ ইতিহাসের সর্বোচ্চ ২৪ দশমিক ৭৭ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। এর ফলে ২০২১ সালের আগস্টে দেশের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি ৪৮ দশমিক শূন্য ৬ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে গিয়েছিল। এ স্ফীতির প্রধান কারণ করোনা মহামারির তাণ্ডবে হুন্ডি ব্যবস্থা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে করোনা পরিস্থিতি স্তিমিত হয়ে যাওয়ায় হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানো আবার চাঙ্গা হয়ে উঠেছিল। ওই অর্থবছরে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহ ১৫ শতাংশ কমে ২১ দশমিক শূন্য ৩ বিলিয়ন ডলারে নেমে গিয়েছিল। অন্যদিকে মহামারির পর অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডে গতি সঞ্চার হওয়ায় ২০২১-২২ অর্থবছরে দেশের আমদানি ব্যয় বেড়ে ৮২ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল। আমদানিতে ব্যাপক ওভার-ইনভয়েসিং হওয়ায় আমদানি ব্যয়ের এই উল্লম্ফন ঘটেছিল বলে ধারণা করা হয়। ওই সময় থেকেই আমি বলে চলেছি, হুন্ডি ব্যবস্থা কঠোরভাবে দমন না করলে আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে রেমিট্যান্স প্রবাহ খুব বেশি বাড়ানো যাবে না। কারণ, হুন্ডি ব্যবস্থার মাধ্যমে দেশ থেকে বিদেশে পুঁজি পাচার বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছে। অতএব, শুধু আমদানি বাণিজ্যের ওভার ইনভয়েসিং, রপ্তানি বাণিজ্যের আন্ডার ইনভয়েসিং এবং রপ্তানি আয় বিদেশে রেখে দেওয়ার সমস্যা নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা নিলেই বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের পতনের ধারা থামানো যাবে না। মাঠ পর্যায়ের গবেষণায় প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে যে পুরোনো পদ্ধতিগুলোর পাশাপাশি এখন প্রবাসী বাংলাদেশিদের বহুল ব্যবহৃত হুন্ডি পদ্ধতিতে রেমিট্যান্স পাঠানোর অভ্যাস পুঁজি পাচারকারীদের একটি সহজ বিকল্প উপহার দিয়েছে। হুন্ডি পদ্ধতিতে বৈদেশিক মুদ্রা যেহেতু বিদেশেই থেকে যায়, তাই কী পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা প্রতি বছর হুন্ডি চক্রে প্রবেশ করছে তার হদিস পাওয়া প্রায় অসম্ভব। কিছুদিন আগে অর্থমন্ত্রী বলেছেন, প্রায় অর্ধেক রেমিট্যান্স এখন হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে আসছে। যদিও আমি মনে করি, সিংহভাগ রেমিট্যান্স প্রেরক হুন্ডি পদ্ধতি ব্যবহার করছেন। অতএব, ২১ বিলিয়ন ডলার যদি ফরমাল চ্যানেলে রেমিট্যান্স আসে তাহলে ২১-২২ বিলিয়ন ডলার বা তার চেয়েও বেশি রেমিট্যান্স (টাকার আকারে) হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশের অর্থনীতিতে ঢুকছে। কিন্তু এই ‘হুন্ডি ডলার’ সমপরিমাণ টাকা রেমিট্যান্স প্রেরকের পরিবারের সদস্য ও আত্মীয়স্বজন যেহেতু পেয়ে যাচ্ছেন, তাই এই অর্থ প্রবাসীদের পরিবার ও স্বজনদের ভোগ এবং বিনিয়োগে ব্যাপক অবদান রাখছে। বিবেচনা করুন, সারাদেশে বিশেষত গ্রামাঞ্চলে প্রবাসীদের পরিবারে পাকা বাড়ি নির্মাণের যে হিড়িক চলেছে তার খরচের কত শতাংশ আনুষ্ঠানিক চ্যানেলে দেশে এসেছে? বলতেই হবে, আনুষ্ঠানিক চ্যানেল বা হুন্ডি পদ্ধতি– যেভাবেই রেমিট্যান্সের অর্থ অর্থনীতিতে প্রবাহিত হোক, এর বহুবিধ সুফল পাচ্ছে অর্থনীতি। কিন্তু যে হুন্ডি ডলার বিদেশেই রয়ে যাচ্ছে, সেগুলো কিনছে দুর্নীতিবাজ কালো টাকার মালিক এবং ব্যাংকের ঋণ নিয়ে ফেরত না দেওয়ার ‘সংস্কৃতি’ সৃষ্টিকারী ব্যবসায়ীরা। মার্জিনখোর রাজনীতিক বলুন, দুর্নীতিবাজ আমলা-প্রকৌশলী বলুন, রাঘববোয়াল ঋণখেলাপি বলুন, ডাকসাইটে ব্যবসায়ী-শিল্পপতি বলুন; হুন্ডি ডলারের সহায়তায় গড়ে উঠছে প্রবাসীদের ঘরবাড়ি, ব্যবসাপাতি, বেগমপাড়া কিংবা সেকেন্ড হোমগুলো। কিছুদিন আগে ১০টি দেশে বাংলাদেশ থেকে সবচেয়ে বেশি অর্থ পাচার হচ্ছে তার তালিকা প্রকাশিত হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে– যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, দুবাই, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, ভারত, কেমেন আইল্যান্ড ও ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড। আবার বিপুল পরিমাণ খেলাপি ঋণ সত্ত্বেও দেশের ব্যাংকগুলো যে বড়সড় সংকটে পড়ছে না, তার পেছনে আনুষ্ঠানিক চ্যানেল কিংবা হুন্ডি পদ্ধতিতে প্রেরিত রেমিট্যান্স থেকে উদ্ভূত বিশাল আমানত প্রবাহ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। এক অর্থে এই বিপুল রেমিট্যান্সের অর্থ বৈদেশিক প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের একটা তাৎপর্যপূর্ণ বিকল্পের ভূমিকা পালন করছে। অনেক দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞ বাংলাদেশের প্রশংসনীয় অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ‘প্যারাডক্স’ আখ্যায়িত করে থাকেন। এত দুর্নীতি সত্ত্বেও দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন তাঁদের কাছে আপাতদৃষ্টিতে স্ববিরোধী। আমার মতে, তাঁরা এই বিপুল রেমিট্যান্স প্রবাহের অভিঘাতকে সঠিকভাবে বিশ্লেষণ করেন না বলেই ব্যাপারটিকে ‘আন্ডার এস্টিমেট’ করছেন। হুন্ডি পদ্ধতির সহায়তায় পুঁজি পাচারের চাহিদার প্রধান গ্রাহক দুর্নীতিবাজ আমলা, প্রকৌশলী, লুটেরা রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ী এবং ব্যাংকঋণ গ্রহীতারা। যেহেতু এমন পুঁজি পাচারকারীরা ব্যাংকঋণ বিদেশে পাচার করার জন্য হুন্ডি ব্যবস্থাকে ব্যবহার করছে, তাই হুন্ডি ডলারের দাম বাংলাদেশ ব্যাংক নির্ধারিত দামের চেয়ে ৮-১০ টাকা বেশি থেকেই যাবে। হুন্ডি ডলারের চাহিদা কাঠামো শক্তিশালী রেখে এই দুই দামের পার্থক্য দূর করা অসম্ভব। সে জন্যই আমি ডলারের দামকে বাজারের কাছে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তাবের বিরোধিতা করে আসছি।আমি মনে করি, হুন্ডি পদ্ধতিতে পুঁজি পাচার দমনে কয়েকটি পদক্ষেপ অপরিহার্য। প্রথমত, অবিলম্বে দেশের এক্সচেঞ্জ হাউসগুলো কিছুদিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা করতে হবে। বেশিরভাগ এক্সচেঞ্জ হাউস হুন্ডি ব্যবসার সঙ্গে জড়িত বলে খবর রয়েছে। দ্বিতীয়ত, পুঁজি পাচারের প্রধান আট-দশটি গন্তব্যে তদন্ত কিংবা গবেষণা প্রকল্প গ্রহণ করা যেতে পারে। যেসব পুঁজি পাচারকারীর নাম তদন্তে উঠে আসবে, তাদের বিভিন্ন ব্যাংকের মালিকানা ও পরিচালনা পর্ষদ থেকে অপসারণ করতে হবে। এসব পাচারকারীকে নতুন কোনো ব্যাংকঋণ দেওয়া যাবে না। এদের কাছে আটক খেলাপি ঋণ আদায়ে ‘খেলাপি ঋণ ট্রাইব্যুনাল’ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। যেসব চাকরিরত আমলা, প্রকৌশলী এবং কর্মকর্তা পাচারকারী প্রমাণিত হবে, তাদের বরখাস্ত এবং চাকরি-পরবর্তী সুযোগ-সুবিধা বাতিল করতে হবে। যেসব রাজনীতিবিদের নাম পাওয়া যাবে, তাদের সব পদ-পদবি থেকে বহিষ্কার করতে হবে। যেসব আমদানিকারকের নাম পাওয়া যাবে, তারা ওভার ইনভয়েসিং করছে কিনা, তা কঠোরভাবে পরখ করতে হবে। সর্বোপরি পুঁজি পাচারকারীর নাম-ঠিকানা সংসদে প্রকাশ করতে হবে।
লেখক: একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ; সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি