সাধন চন্দ্র মজুমদার এমপি
জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল সংক্ষেপে এসপিডি পৃথিবীর অন্যতম পুরোনো ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল। এই দলটির রয়েছে অনেক চড়াই-উতরাইয়ের ইতিহাস। সব রাজনৈতিক দলেরই নিজস্ব একটা মিথ থাকে। এসপিডি দাবি করে, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে পুরোনো রাজনৈতিক দল। অষ্টাদশ শতাব্দীর মধ্যভাগে যখন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার ছিল না বললেই চলে তখন জার্মানির এক দল লোক এটা নিয়ে কথা বলতে শুরু করে। একসময় সংগঠিত হয় এবং রাজনৈতিকভাবে শক্তি অর্জনে সক্ষম হয়। এ কাজের বড় অংশের অবদান ছিল ফার্ডিল্যান্ড লাসালের। ধনাঢ্য পরিবারে জন্মগ্রহণ করেও আজীবন শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াই করে গেছেন। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান যা করেছেন। পৃথিবীতে গুটি কয়েক ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল প্রতিষ্ঠা লাভ করেছিল। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের আব্রাহাম লিংকনের রিপাবলিকান সেরকমই একটি দল। এ দলটি জার্মানের এসপিডির ৯ বছর পূর্বে ১৮৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। রিপাবলিকান দলটি এখনো যুক্তরাষ্ট্র দাপটের সঙ্গে রাজনীতি করছে। যুক্তরাষ্ট্রে আরেকটি ঐতিহ্যবাহী রাজনৈতিক দল ডেমোক্রেটিক পার্টি। রিপাবলিকান আর ডেমোক্র্যাটদের মধ্যেই ক্ষমতার প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়ে আসছে দীর্ঘদিন থেকে। ভারতে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস অনেক পুরোনো এবং ঐতিহ্যবাহী দল। এই দলটি প্রতিষ্ঠিত হয় ১৮৮৫ সালে। বাংলাদেশের আওয়ামী লীগের সঙ্গে জার্মানির সামাজিক গণতন্ত্রী দল এসপিডির অনেকটা মিল রয়েছে। দলের প্রথম পুস্তিকায় ফার্ডিনান্ড বলেছিলেন, ‘এই সংগঠনে ১ লাখ জার্মানি শ্রমজীবী মানুষ জড়ো হলেই তা এমন শক্তিতে পরিণত হবে, যাতে সবার হিসাব করে চলতে হবে।’ তার এই কথা বাস্তবে রূপ পেয়েছিল। দলটি এতটাই জনপ্রিয় ছিল শেষ পর্যন্ত জার্মানির তদানীন্তন চ্যান্সেলর দলটি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। নিষিদ্ধের পর দলটির নেতাকর্মীদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন ও নিপীড়ন। প্রায় ২০ বছর পর্যন্ত এই নির্যাতন অব্যাহত থাকে। ১৯৩৩ সালে হিটলার ক্ষমতায় এসে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে এসপিডির বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ায়। এসপিডি রাজনৈতিক সংকটকালে দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়লেও পরবর্তী সময়ে এক হয়ে পুঁজিবাদী দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করে। ১৯৫৯ সালের সম্মেলনে এসপিডি শক্তিশালী সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সঙ্গে বাজার অর্থনীতিকে গ্রহণ করে। ১৯৯৮ সালে এসপিডি থেকে গেয়ারহার্ড শ্রোয়েডার জার্মানির চ্যান্সেলর হন। এরপর পার্টির ধরন বদলে যায়। শ্রোয়েডার এসপিডিকে শ্রমজীবী মানুষের দল থেকে নতুন মধ্যবিত্ত শ্রেণির দলে পরিণত করেন। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠাকালীন শেখ মুজিবুর রহমান দলটির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক হলেও অতি অল্প সময়ের ব্যবধানে তিনি শীর্ষ নেতৃত্বের আসনে চলে আসেন। তার রাজনৈতিক প্রজ্ঞা মেধা এবং জনপ্রিয়তা তাকে যথা জায়গায় অধিষ্ঠিত করে। মূলত শেখ মুজিবই আওয়ামী মুসলিম লীগকে আওয়ামী লীগে রূপান্তর করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। মননে তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক, মানবিক মূল্যবোধসম্পন্ন মহান ব্যক্তি। উল্লেখ্য, ২৪ বছরের পাকিস্তান শাসন আমলে আওয়ামী মুসলিম লীগ আতাউর রহমান খানের নেতৃত্বে দুই বছর প্রদেশে ক্ষমতাসীন ছিল এবং হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে কেন্দ্রে ১৩ মাস কোয়ালিশন সরকারের অংশীদার ছিল। পরবর্তী সময় ১৯৫৫ সালে অসাম্প্রদায়িক চেতনার আলোকে আওয়ামী লীগ গঠিত হলে দলে মতপার্থক্য তৈরি হয়। পররাষ্ট্র নীতিবিষয়ক মতপার্থক্যকে সাক্ষী করে দলটি বিভক্ত হয়ে যায় ১৯৫৭ সালে টাঙ্গাইলের কাগমারী সম্মেলনের মাধ্যমে। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীর নেতৃত্বে নতুন দল ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির আত্মপ্রকাশ ঘটে। শেখ মুজিবুর রহমান সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেই আওয়ামী লীগকে সাধারণ মানুষের দলে পরিণত করেন। ইতিহাস আজীবন কথা বলে। ইতিহাস মানুষকে ভাবিয়ে তোলে। তাড়িত করে। প্রতিদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা কালক্রমে রূপ নেয় ইতিহাসে। ইতিহাসের দিনপঞ্জি মানুষের কাছে সব সময় গুরুত্ব বহন করে। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ১৬৯ আসনের মধ্যে ১৬৭টি আসনে জয় লাভ করে। পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর স্বৈরতান্ত্রিক মনোভাব ও শোষণের বিরুদ্ধে জনতার রায়ে আওয়ামী লীগের এই মহা জয় হলেও ক্ষমতায় বসতে পারে না আওয়ামী লীগ। যুদ্ধের দিকে অগ্রসর হয় পাকিস্তান। বঙ্গবন্ধু তার রাজনৈতিক জীবনের বেশির ভাগ সময়ই জেল খেটেছেন। জেল জীবনের ইতিহাস সমৃদ্ধ করেছে রাজনৈতিক ইতিহাসকে। ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করে শত্রুরা। কাপুরুষোচিত এই হত্যাকাণ্ডে বিশ্ববাসী বিস্মিত হয়। বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তন ঘটে। আওয়ামী লীগ বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। বিপন্ন হয়ে ওঠে আমাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব। সৌভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধু দুই কন্যা শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা বেঁচে যাওয়ায় আওয়ামী লীগ ও দেশ বেঁচে যায়। ’৭৫-পরবর্তী ছয় বছর পর বিপর্যস্ত আওয়ামী লীগের হাল ধরেন শেখ হাসিনা। দীর্ঘ সময় তার নেতৃত্বে দল ক্ষমতার মুখ দেখতে সক্ষম হয়। শেখ হাসিনার যোগ্য নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ’৭৫-পরবর্তী ২১ বছর নির্যাতিত হওয়ার পর প্রথমবার ক্ষমতায় আসে। রাজনৈতিক নানা ঘটনাপরম্পরায় ২০০৮ থেকে একটানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় রয়েছে দলটি। দেশীয় আন্তর্জাতিক নানা ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে টিকে আছে দল ও আমাদের স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। ইতিহাস সাক্ষী দেবে আগামী দিনে যে আওয়ামী লীগই একমাত্র বাংলাদেশের রাজনৈতিক দল, যে দলটি স্বপ্ন দেখায় ও বাস্তবায়ন করে। বর্তমান বিশ্বরাজনীতির প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাঙালি জাতির আলোকময় ভবিষ্যত্ বিনির্মাণে কাজ করে যাচ্ছে। আয়ামী লীগের বর্ণময় ইতিহাস কমবেশি সবারই জানা। এবারের তাত্পর্যময় প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীর অঙ্গীকার, এগিয়ে যাবে আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশ।
লেখক: খাদ্যমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার