লোহা কেন খাবেন?
ডা: সুমাইয়া আক্তার
অনেকেই হয়তো আঁতকে উঠছেন! তাই বলে- লোহা??
হুম, লোহা। ইংরেজিতে যাকে বলে আয়রণ। রাসায়নিক সংকেত (Fe)। ফেরাস আর ফেরিক এই দুই ধরনের লোহা আছে।
লোহা শুধু মানুষই না, সকল মেরুদন্ডী প্রাণীর দেহ গঠণের একটি অন্যতম মৌলিক উপাদান। খ্রীস্টপূর্ব যুগ থেকেই লোহা চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত হয়ে আসছে। গ্রিক, মিশরীয় ইতিহাসে গ্রীন ডিজিজ নামের একটি রোগে লোহা ব্যবহারের কথা জানা যায়। এছাড়া ভারতীয় সভ্যতার ইতিহাসেও চিকিৎসায় লোহা ব্যবহারের কথা উল্লেখ আছে। তবে লোহার সবচেয়ে বড় প্রয়োজনীয়তাটি আবিষ্কার হয় গত শতাব্দীর শেষের দিকে ১৮৭০ সালে।
আমাদের রক্তের ৩ ধরনের কনিকার মধ্যে একটি হলো লোহিত রক্ত কনিকা। যার মূল অংশের নাম হিমোগ্লোবিন। এর হিম আর গ্লোবিন দু’টি অংশ। হিম অংশের মূল উপাদান হলো আয়রণ বা লোহা। এর সবচেয়ে বড় কাজটি হলো- আমরা নিঃশ্বাসের মাধ্যমে যে অক্সিজেন টেনে নেই তা বহন করে শরীরের সব কোষে কোষে পৌঁছে দেওয়া। আর অক্সিজেন ছাড়া কোনো কোষ বাঁচতে পারে না, মানে কোনো প্রাণী বাঁচতে পারে না।
লোহা আমাদের শরীরে ফেরিটিন আর হিমোসিডারিন হিসেবে লিভার, প্লীহা, বোন ম্যারো, মাংসপেশীর মায়োগ্লোবিনে জমা থাকে।
খাবারের মাধ্যমে আমরা প্রয়োজনীয় লোহা পাই।
এর ঘাটতিজনিত রোগের নাম এনিমিয়া বা রক্তশুন্যতা।
রক্তশূন্যতা কখন কাদের হয়?
১. খাদ্যে ঘাটতি থাকলে অর্থাৎ আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার না খেলে।
২. বয়ঃসন্ধি বা growing time -এ চাহিদা বেশি থাকে। তখন চাহিদা পূরণ না হলে।
৩. মেয়েদের প্রতি মাসের মাসিক চক্রের কারণে যে রক্তক্ষরণ হয় তা পূরণ করতে তাদের পুরুষের চেয়ে বেশি চাহিদা থাকে।
৪. গর্ভাবস্থায় ও প্রসূতি মায়েদের।
৫. কৃমির সংক্রমণ, কোনাে কারণে রক্তক্ষরণ।
৬. কিছু রোগের জন্য।
রক্তশূন্যতার লক্ষণ কী?
- দুর্বলতা।
- অল্প কাজেই হাপিয়ে ওঠা।
- palpitation বা বুক ধড়ফড় করা।
- ফ্যাকাশে ত্বক।
- খাবারে অরুচি।
- রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমে গিয়ে নানান রোগের সংক্রমণ।
- শ্বাসকষ্ট।
- শিশু ও টিন-এজদের বৃদ্ধি ও বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে।
- অতিরিক্ত রক্তশুন্য হলে সারা শরীরে পানি আসা বা ফুলে যাওয়া (oedema)।
প্রতিরোধ কীভাবে করা যায়?
১. প্রতিদিন আয়রন সমৃদ্ধ খাবার গ্রহণ।
২. যাদের বাড়তি চাহিদা রয়েছে, যেমন: টিনএজ ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে মেয়ে বাচ্চা, মাসিক হয় এমন মহিলা (menstruating woman) গর্ভবতী (pregnant) ও দুগ্ধদানকারী মা (lactating mother) দেরকে আয়রণ সমৃদ্ধ খাবারের পাশাপাশি প্রয়োজনে supplement দিতে হবে।
কোন খাবারে কতো আয়রণ?
আয়রণ আমাদেরকে দৈনন্দিন খাবার থেকেই সংগ্রহ করতে হবে। আয়রণ সমৃদ্ধ খাবার দুই ধরনের রয়েছে– হিম (heme) এবং নন-হিম (non heme)। হিম সাধারণত প্রাণীজাতীয় পণ্য বিশেষত পোলট্রিজাত জিনিস ও মাংসে পাওয়া যায়। হিম-আয়রণ নন-হিম আয়রণের চেয়ে দ্রুত শরীরে শোষিত (absorption) হয়।
১. মাংস : (red meat)- ১০০ গ্রামে প্রায় ২.৭ মিলিগ্রাম; মুরগির মাংস- ৫ আউন্সে প্রায় ৫ মিলিগ্রাম
২. ডাল : আধা কাপ ডাল এ ৬.২৫ মিলিগ্রাম
৩. কলিজা : ১০০ গ্রামে ৬.৫ মিলিগ্রাম
৪.পালংশাক : ১০০ গ্রামে ৩.৬ মিলিগ্রাম
৫. শিম ও মটরশুঁটি : ১০০ গ্রামে ৩.৩ মিলিগ্রাম
৬. ডার্ক চকলেট : ২৮ গ্রামে ৩.৩ মিলিগ্রাম
৭. সামুদ্রিক মাছ : ১০০ গ্রামে ২৮ মিলিগ্রাম
এছাড়াও ডিমের কুসুম, আনার, আপেল, খেজুর, বাদাম, কুমড়ার বীজ, কচু, কাঁচাকলার তরকারি, ফুলকপি ইত্যাদিতেও প্রচুর আয়রণ রয়েছে।
কার কতোটা আয়রণ প্রয়োজন?
(Recommended Dietary Allowances (RDAs) for Iron) প্রতিদিনের চাহিদা :
বয়স – পুরুষ – মহিলা
১–৩ বছর – ৭ মিলিগ্রাম – ৭ মিলিগ্রাম
৪-৮বছর – ১০ মিলিগ্রাম – ১০ মিলিগ্রাম
৯–১৩ বছর – ৮ মিলিগ্রাম – ৮ মিলিগ্রাম
১৪–১৮ বছর – ১১ মিলিগ্রাম – ১৫ মিলিগ্রাম
১৯–৫০বছর – ৮ মিলিগ্রাম – ১৮ মিলিগ্রাম
৫১+ – ৮ মিলিগ্রাম – ৮ মিলিগ্রাম
গর্ভবতী – দুগ্ধ দানকারী
২৭ মিলিগ্রাম – ১০ মিলিগ্রাম
যদি দেহে আয়রণের অভাব খুব বেশি থাকে তবে অবশ্যই ডাক্তারের পরামর্শ অনুযায়ী আয়রণ সাপ্লিমেন্ট গ্রহণ করতে হবে।
কিছু জরুরি কথা :
খাবার থেকে আয়রণ শোষন কিছু বিষয়ের উপর নির্ভরশীল। এগুলোও আমাদের জানা থাকা দরকার।
- ভিটামিন সি আয়রণ শোষণে সাহায্য করে। তাই সাইট্রাস জাতীয় ফল (টক ফল) সবুজ শাকসবজী ও নিয়মিত খাওয়া উচিত।
- খালিপেটে আয়রণ শোষণ ভালো হয়। তবে এতে প্রচুর এসিডিটি হয় বলে অনেকেই খেতে পারেন না। তাই নিয়মিত, অন্য খাবারের সাথে খাওয়া যায়।
- আয়রণ সাপ্লিমেন্ট বা মেডিসিন খাবারের মাঝে খেতে পারেন।
- ক্যালসিয়াম সমৃদ্ধ খাবার (দুধ) আয়রণ শোষণ বাধাগ্রস্ত করে। এগুলো একসাথে খাওয়া উচিত নয়।
- এন্টাসিড জাতীয় ঔষধের ক্ষেত্রেও একই কথা।
পৃথিবী জুড়ে মানুষের যেসব রোগ হয় তার ২০% এর কারণ রক্তশুন্যতা। তাছাড়া ৫০% মাতৃ মৃত্যুর পরোক্ষ কারণও এটি। রক্ত শূন্যতার প্রতিরোধ প্রতিকারে তাই আয়রণের বিকল্প নাই।
‘এবং আমি লোহা দিয়েছি যাতে রয়েছে প্রচন্ড শক্তি এবং মানুষের জন্য বিবিধ কল্যাণ’। -(সুরা হাদিদ/৫৭:২৫)।
নিশ্চয়ই সবচেয়ে বড় কল্যাণটি আমরা বুঝতে পারছি।
যতক্ষণ শ্বাস ততক্ষণ আশ। লোহার বানানো হিমোগ্লোবিন আপনার নিঃশ্বাসে টেনে নেয়া অক্সিজেন সারা শরীরে পৌঁছে দেয়। স্রষ্টার চেয়ে সৃষ্টিকে আর কে-ই বা ভালো জানে?
(লেখক :
এফসিপিএস (অবস অ্যাড গাইনী)
রিপ্রোডাক্টিভ এন্ডোক্রাইনোলজি এণ্ড ইনফার্টিলিটি
বিএসএমএমইউ)
আলোকিত প্রতিদিন/১৪ আগস্ট-২০২০/জেডএন