মৌনতার স্বপ্নভঙ্গ
মমতা নূর
—————————————————————————————————-
দুচোখের ভারি পাতা সরিয়ে চোখ খুললো রাতুল। ঘরের আশপাশ ভালো করে দেখলো। অল্পকিছু আসবাবের ছোট্ট পরিপাটি করে সাজানো। অচেনা। বিছানার পাশের জানালা দিয়ে আকাশ উঁকি দিচ্ছে- সুন্দর সফেদ আকাশ। কিন্তু সেদিকে তাকাতেই চোখের ওপর অত্যাচার করা হলো যেনো! চোখ বন্ধ করে নিলো রাতুল।
কারো পায়ের শব্দ শোনা যাচ্ছে। শব্দটি আস্তে আস্তে ঘরের দরজায় আসলো। দরজা খুলে ভেতরে ঢুকলো। টেবিলের উপর কিছু রাখার স্পষ্ট শব্দ শুনতে পেলো রাতুল। কৌতুহল জাগছে, কিন্তু চোখ মেলতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কৌতুহল জন্মালে অন্ধও চোখ মেলতে চায়। এটাই নিয়ম। অথচ রাতুলের ক্ষেত্রে ঘটছে অন্যরকম। মনে হচ্ছে বহুকাল আলোতে চোখ রাখেনি। খুললেই ঝলসে যাবে মগজ অবধি!
কপালে আলতো হাতের ছোঁয়ার অনুভব। চোখ দুটো ঈষৎ কেঁপে উঠলো। তবু পাতা দুটো বেহায়ার মতো বসেই রইলো, একটুও নড়লো না। কপালে হাতের ছোঁয়ার সাথে সাথে মেয়েলি কণ্ঠে তার নাম ধরে ডাকতেও শুনতে পেলো।
রাতুল নিরুত্তর। পায়ের শব্দটি চলে গেলো। চোখ বন্ধ করেই রাতুল অন্ধের অনুভূতি নিতে চেষ্টা করলো। টেবিলে যে খাবার রাখা হয়েছে তা সে বুঝতে পারছে। ঘ্রাণ শুঁকে কী খাবার তা বোঝার চেষ্টা করলো; পারলো না। এখন কয়টা বাজে এটা বুঝতে পারলে অন্তত কোন বেলার খাবার তা আন্দাজ করা যেত। এ ঘরের কোথাও একটা ঘড়ি দেখেছে বলে মনে পড়ছে। ঘড়িটির সেকেন্ডের কাঁটার গতির টিক টিক শব্দে জানানও দিচ্ছে। ঘড়ি দেখার জন্য চোখ মেলা দরকার। কিন্তু ওই যে, মন চাইছে না। মনে হচ্ছে- মগজ অবধি ঝলসে যাবে!
রাতুল ভাবনার চাকা অন্য দিকে ঘোরালো। যে মেয়েলি কণ্ঠে একটু আগে তার নাম ডাকতে শুনেছে, তিনি মধ্যবয়সী কেউ হবেন। ভদ্রমহিলা মনে হয় কম কথা বলেন। রাতুলকে দ্বিতীয়বার ডাকেননি।
আবার পায়ের শব্দ। শব্দটি সোজা তার কাছে এগিয়ে এলো। অন্য একটি পায়ের শব্দ টেবিলের কাছে গিয়ে থামলো। এরা ঠিক কারা রাতুল বুঝতে পারছে না। কিভাবে এখানে এলো তাও মেলাতে পারছে না। একটু ভাবার চেষ্টা করলো।
নতুন বাজার থেকে একটি শাড়ি কিনে রুনির সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলো রাতুল। বাবা-মা-হীন রাতুলের জীবনে রুনি ছিলো সাধনার মতোন। ভালোবেসেছিলো খুব যতন করে। সব সম্পর্কেই ছোটখাটো মান অভিমান থাকে। তাদেরও ছিলো। অভিমান করে রুনি টানা একদিন কথা বলেনি। থাকতে পারছিলো না রাতুল। তাই মান ভাঙ্গাতে একটি শাড়ি কিনে এলাকার এক ছোট ভাইকে দিয়ে পাঠিয়ে রুনিকে ডেকে আনবে ভেবেছিলো। শাড়িটি প্যাকেট করে উপরে রুনির বাড়ির ঠিকানা লিখেছিলো। ঝাপসা যা কিছু মনে করতে পারলো তার সারমর্ম এমনি দাঁড়ায়। কিন্তু তারপর…
চোখ মেললো রাতুল। খাটের পাশের চেয়ারে বসা স্নিগ্ধ একজোড়া চোখ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চোখে চোখ পড়তেই মেয়েটির চোখ জোড়া হেসে উঠলো। টেবিলের পাশে একজন মধ্যবয়সী ভদ্রমহিলা।
‘এখন কেমন লাগছে?’ পাশে বসে থাকা তরুণীর প্রশ্ন।
উত্তর দিতে ইচ্ছে করলো না রাতুলের। তাকিয়ে থাকলো তরুণীর চোখের দিকে।
‘অবশেষে আপনি কিছুটা হলেও সুস্থতায় ফিরছেন বলে মনে হচ্ছে। গত একমাস আপনার যে অবস্থা ছিলো! আমি তো ভেবেছিলাম…। তবে বলতেই হয়, আপনার মনের জোর ভীষণ। মনের জোর আর ভাগ্য ভালো বলেই এমন একটা এক্সিডেন্টের পরও আপনি চোখ মেলে আছেন। হসপিটালেই রাখতে পারতাম, কিন্তু দুইদিন অবস্থা বেশ ভালো ছিলো। তাই বাড়িতে নিয়ে এলাম। পাশেই হসপিটাল। আমি ওই হসপিটালের নার্স।’
রাতুল এবারো চুপ। ঘাড় ঘুরিয়ে আর একবার দাঁড়িয়ে থাকা মহিলার দিকে তাকালো।
‘আমার সাথে থাকেন উনি। আমার কেউ নেই। বলতে পারেন উনিই এখন আমার সব। আপনাকে তো এক্সিডেন্ট স্পট থেকে উনিই নিয়ে এসেছিলেন। তারপর একটা মাস আপনার কাছ থেকে একটুও নড়েননি। হসপিটালের রাতগুলো নির্ঘুম কাটিয়েছেন।’ আগ্রহের সাথে বলে চললো মেয়েটি। রাতুল চোখ ফেরালো মেয়েটির দিকে। শাড়িটি খুব চেনা চেনা লাগছে।
‘আপনার অনুমতি ছাড়াই শাড়িটা পরেছি বলে রাগ করতে পারেন। আপনার কোন পরিচিত জনের খোঁজ না পেয়ে প্যাকেটের গাঁয়ে লেখা ঠিকানাতে গিয়েছিলাম। কিন্তু ওইদিন ওবাড়ির মেয়েটির বিয়ে হচ্ছিলো। সবাই বেশ ব্যস্ত ছিলো তাই কারো সাথে কথা বলতে পারিনি। পরে আবার গিয়েছিলাম, কিন্তু কাউকে পাইনি।’
বুকের মধ্যে একটা গোপনে লালন করা ব্যথা চিনচিন করে ওঠে রাতুলের। ‘আপনি কি কিছু মনে করতে পারছেন?’, উৎসাহী প্রশ্ন ছেদ করলো রাতুলের শরীর, মন, মস্তিষ্ক।
চোখ জোড়া তরুণীর মায়ামাখা চোখে স্থির হয়ে রইলো। সেই চোখ বলছে, কিছু না মনে পড়লেই ভালো ছিলো। কখনো কখনো বলছে- এই আলো আলো নয়, অন্য কিছু!