আজ বৃহস্পতিবার, ৫ বৈশাখ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ ।   ১৮ এপ্রিল ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ

না ফেরার দেশে কবি ও সাংবাদিক ফখরে আলম

-Advertisement-

আরো খবর

- Advertisement -
- Advertisement -

::প্রতিনিধি, যশোর::
যশোরের প্রথিতযশা সাংবাদিক দৈনিক কালের কণ্ঠ’র বিশেষ প্রতিনিধি কবি ফখরে আলম আর নেই। ষাট বছর বয়সী কবির কবিতায় ‘পাতাসি’ চরিত্রটি রয়েছে মানুষের মুখে মুখে। তিনি যশোর জেলা ব্রান্ডিং ‘নকশিকাঁথা ফুলের মেলা, খেজুরগুড়ের যশোর জেলা’ স্লোগানটি তারই রচিত।
বৃহস্পতিবার সকালে তিনি নিজ বাড়িতে অসুস্থ হয়ে পড়লে যশোর ২৫০ শয্যা জেনারেল হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। সকাল সাড়ে ৯টার দিকে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন। আট বছর ধরে তিনি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। মৃত্যুকালে তিনি মা রওশন আরা বেগম, স্ত্রী নাসিমা আলম, কন্যা নাজিফা আলম মাটি ও পুত্র ফাহমিদ হুদা বিজয়সহ অসংখ্য আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু বান্ধব ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন।
এদিন বাদ আসর যশোর জিলা স্কুল মাঠে তার নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়। এরপর গ্রামের বাড়ি শহরতলীর চাঁচড়ায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে ২য় নামাজে জানাজা শেষে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়। ফখরে আলম ২০১২ সালের জানুয়ারি মাসে আমি ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। এরপর থেকে তিনি ভারতের টাটা হাসপাতালে চিকিৎসা নিয়ে স্বাভাবিক জীবন যাপন করছিলেন। ২০১৮ সালের ০২ এপ্রিল ক্যান্সারের কারণে তিনি দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন।
এদিকে, ফখরে আলমের মৃত্যুতে গভীর শোক ও দুঃখ প্রকাশ করেছেন যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের (যবিপ্রবি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. মোঃ আনোয়ার হোসেন, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে) সভাপতি সাজেদ রহমান, সহ সভাপতি প্রণব দাস, সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান মিলন, যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম রুবেল, কোষাধ্যক্ষ মারুফ কবীর এবং জেইউজে নির্বাহী সদস্য শফিক সায়ীদ ও জিয়াউল হক, বিএফইউজে-বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন’র সহ সভাপতি মনোতোষ বসু, যুগ্ম মহাসচিব সাকিরুল কবীর রিটন, নির্বাহী সদস্য নূর ইমাম বাবুল ও গোপীনাথ দাস, সাংবাদিক ইউনিয়ন যশোরের সভাপতি শহিদ জয়, সহসভাপতি মুর্শিদুল আজিম হিরু, সাধারণ সম্পাদক আকরামুজ্জামান, যুগ্ম সম্পাদক এসএম ফরহাদ, দপ্তর সম্পাদক ইকতিয়ার রহমান ইমন, কোষাধ্যক্ষ গালিব হাসান পিল্টু, ক্রীড়া ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মীর কামরুজ্জামান মনি ও সদস্য সাইফুর রহমান সাইফ।

কবি ফখরে আলম ১৯৬১ সালের ২১ জুন যশোরে জন্মগ্রহণ করেন। মা রওশনআরা বেগম গৃহিনী। বাবা শামসুল হুদা ছিলেন পুলিশ কর্মকর্তা। ১৯৭৭ সালে যশোর জিলা স্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৭৯ সালে সরকারি এমএম কলেজ থেকে এইচএসসি, ১৯৮১ সালে ঐ কলেজ থেকে তিনি বিকম পাশ করেন। ১৯৮৩ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি হিসাব বিজ্ঞানে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করেন। ১৯৮৫-৮৬ সালে ইত্তেফাক গ্রæপের সাপ্তাহিক ‘রোববার’ পত্রিকায় প্রতিবেদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। ১৯৯১ সালে দৈনিক আজকের কাগজের যশোর জেলা প্রতিনিধি পদে যোগ দিয়ে পেশা হিসেবে সাংবাদিকতাকে বেছে নেন। এরপর দৈনিক ভোরের কাগজ, দৈনিক বাংলাবাজার পত্রিকা, দৈনিক মানবজমিন, দৈনিক জনকণ্ঠ, দৈনিক আমাদের সময়, দৈনিক যায়যায় দিন ও দৈনিক কালের কণ্ঠ পত্রিকায় ১৯৯২ সাল থেকে স্টাফ রিপোর্টার, সিনিয়র রিপোর্টার, বিশেষ প্রতিনিধি পদে দায়িত্ব পালন করেছেন। ২০০০ সালে দৈনিক জনকণ্ঠ পত্রিকায় তিনি এদেশে সবচেয়ে সাড়া জাগানো সিরিজ রিপোর্ট ‘সেই রাজাকার’ লেখা শুরু করেন। তিনি অনুসন্ধান চালিয়ে যশোরে কয়েকটি বধ্যভূমি খুঁজে বের করেন। মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক তাঁর দু’টি গ্রন্থ রয়েছে। তিনি পত্র-পত্রিকায় বঙ্গবন্ধুর জানা-অজানা বিষয় নিয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদন লিখেছেন। এ বিষয়ক ‘জানা-অজানা বঙ্গবন্ধু’ বলে তার একটি ব্যতিক্রমধর্মী গবেষণা গ্রন্থ রয়েছে।
কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় ফখরে আলম বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছেন। কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় তিনি ১৯৯৮ সালে বার্ক এর প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। একই বছর তিনি কৃষি বিষয়ক সাংবাদিকতায় বিসিডিজেসি ও নোভার্টিজ এর ফেলোশিপ অর্জন করেন।
স্কুল জীবন থেকেই তিনি কবিতা লিখছেন। দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রায় সব পত্র-পত্রিকায় তার কবিতা ছাপা হয়েছে। বাংলা একাডেমীর উত্তরাধিকার ও পশ্চিমবঙ্গের শিব নারায়ন রায় সম্পাদিত জিজ্ঞাসা পত্রিকায় তার কবিতা স্থান পেয়েছে। ১৯৮০-৮১ সালে ফখরে আলম যশোর সরকারি এমএম কলেজের ছাত্র সংসদের সাহিত্য সম্পাদক নির্বাচিত হন। দায়িত্ব পালন কালে তিনি কলেজ বার্ষিকী সম্পাদনা করেন। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে তার কবিতা দেশ জুড়ে আলোড়ন সৃষ্টি করে। তিনি ১৯৯১ সালে যশোর সাহিত্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে থাকার সময় দেশ বিদেশের খ্যাতিমান কবি, সাহিত্যিকদের নিয়ে একটি সাহিত্য সম্মেলনের আয়োজন করেন। এরপর ২০০৫ সাল পর্যন্ত তিনি যশোর সাহিত্য পরিষদের সভাপতির দায়িত্বে ছিলেন।
তিনি প্রথম পুরস্কার, পুষ্প প্রদর্শনী, সৌখিন ফুল পাখি চাষি পরিষদ-১৯৯৫, প্রথম পুরস্কার, বৃক্ষ মেলা, জেলা প্রশাসন-বন বিভাগ, যশোর-১৯৯৬, প্রথম পুরস্কার, বৃক্ষ মেলা, জেলা প্রশাসন-বন বিভাগ, যশোর-১৯৯৭, ফল বৃক্ষ রোপনে জাতীয় পুরস্কার, কৃষি মন্ত্রণালয় ২০০৬, বৃক্ষ রোপণে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কার- ২০০৭ সহ যশোরের কৃষি ও বৃক্ষ মেলায় অনেক পুরস্কার অর্জন করেছেন।
সাংবাদিকতায় ১৯৯৭ সালে মোনাজাতউদ্দিন স্মৃতি পুরস্কার, একই বছর এফপিএবি পুরস্কার, ২০০০ সালে মধুসূদন একাডেমী পুরস্কার, ঐ বছরই বাংলাদেশ পরিবেশ সাংবাদিক ফোরাম পুরস্কার, ২০০২ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ অনুসন্ধানী সাংবাদিকতা পুরস্কার এবং বৃক্ষ রোপনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার জন্য ফখরে আলম ২০০৬ সালে কৃষি মন্ত্রণালয়ের জাতীয় পুরস্কার ও ২০০৭ সালে প্রধান উপদেষ্টার জাতীয় পুরস্কার অর্জন করেন। সাংবাদিকতায় ২০১১ সালে তিনি অশোক সেন স্মৃতি পুরস্কার পান। ২০১২ সালের ডিসেম্বর মাসে আন্তর্জাতিক স্বেচ্ছাসেবা দিবস উপলক্ষে ফখরে আলমকে জেগে ওঠো ফাউন্ডেশন সম্মাননা স্মারক প্রদান করে। ২০১৩ সালে ডিজিটাল যশোর বিনির্মাণে জেলা প্রশাসক তাকে সম্মাননা প্রদান করে। ফখরে আলম সাংবাদিকতায় ২০১৪ সালে প্রকৌশলী কামরুল ইসলাম সিদ্দিক পুরস্কার, ২০১৭ সালে ঋষিজ শিল্পী গোষ্ঠি পুরস্কার, একই বছর যশোর ব্র্যান্ডিং পুরস্কার, ২০১৮ সালে যশোর পৌরসভার ভৈরব পদকসহ আরও কয়েকটি পুরস্কার অর্জন করেন। একই বছর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি তাঁকে গুণীজন সম্মাননা প্রদান করে। ২০১৯ সালে যশোরের স্বগত কণ্ঠ তাকে কবি সম্মাননা প্রদান করে। এছাড়া এই বছর তিনি মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক প্রতিবেদনের জন্যে সেরা প্রতিবেদক হিসেবে বজলুর রহমান স্মৃতিপদক পান।
ফখরে আলমের ৩৮টি গ্রন্থ রয়েছে। তিনি যশোরের চাঁচড়া কমিউনিটি ক্লিনিক ও কবরস্থানের প্রতিষ্ঠাতা। এছাড়া প্রেসক্লাব যশোর, যশোর সাংবাদিক ইউনিয়ন (জেইউজে), যশোর ইনস্টিটিউট, যশোর সাহিত্য পরিষদ, আঞ্জুমানে মুফিদুল ইসলাম যশোরের সদস্য। সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোট, উদীচী, জাতীয় রবীন্দ্র সংগীত সম্মিলন পরিষদসহ আরও কয়েকটি সামাজিক সাংস্কৃতিক সংগঠনের সম্পৃক্ত ছিলেন।

- Advertisement -
- Advertisement -